.
শর্ত পূরণের অঙ্গীকারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে পাওয়া যাবে আরও ১০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা। এরমধ্যে অন্যতম তিন শর্ত হচ্ছে- দ্রুত বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলারের রিজার্ভ বাড়ানো এবং ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করা। এই তিন শর্ত পরিপালনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে। বিশেষ করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে সরাসরি জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে ভবিষ্যতে দ্রব্যমূল্য আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে রিজার্ভ বাড়াতে গিয়ে ডলারের দাম আরেকদফা বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া কর ও ভ্যাট ব্যাপকহারে বাড়ানো এবং এর সংস্কার নিয়ে ব্যবসায়ীদের আপত্তি রয়েছে।
জানা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া, দ্রব্যমূল্য হ্রাস এবং জনজীবনে স্বস্তি দিতে আইএমএফের ঋণ চায় বর্তমান সরকার। এ কারণে আইএমএফের শর্ত পূরণে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সরকার। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়তে পারে কিংবা দ্রব্যমূল্য বেড়ে আরও মূল্যস্ফীতির মতো আশঙ্কা তৈরি হতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও সংস্থাটির সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠকের পর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ নতুন করে আরও ৩০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা চেয়ে আসছেন। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণ করেও তিনি ঢাকার পক্ষ থেকে এই ঋণ সহায়তা চান। এরপরই সংস্থাটি তাদের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে পাঠায় এবং নতুন ঋণ প্রদানের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে। সংস্থাটি আপাতত শর্ত সাপেক্ষে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। তবে এই ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে আগামী ৬ মাস পর। ইতোমধ্যে নতুন ঋণ ছাড়ের জন্য বাড়তি ৬ মাস সময় চেয়েছে আইএমএফ।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সরকার বদলের পরেই অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আইএমএফের কাছে নতুন করে ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণের প্রস্তাব দেন। এই ঋণ নিয়ে আইএমফের ঢাকায় সফররত মিশনের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সংস্থাটি ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণের বাইরেও নতুন ঋণ নিয়ে আলোচনা করে। আইএমএফ প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি ডলার বা এক বিলিয়নের একটি বিকল্প প্রস্তাব দেয়। একই সঙ্গে নতুন ঋণ ছাড়ের জন্য কিছু নতুন সংস্কার প্রস্তাব দেয় সংস্থাটি। আইএমএফের চলমান মিশনের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে শর্ত পূরণে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্মতি জ্ঞাপন করে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, এবার আইএমএফ রাজস্ব আদায় বাড়ানো, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সার খাতে ভর্তুকি কমানো এবং ব্যাংকিং খাতের সুশাসনের ওপর জোর দিয়েছে। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরের বাজেটে কর অব্যাহতি সংক্রান্ত সরকারের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। তা ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পলিসি ও প্রশাসনকে আলাদা করতে এবং একাধিক ভ্যাট হার কমানোর শর্ত আরোপ করতে পারে। উল্লেখ্য, আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। এরপর তিন কিস্তিতে সংস্থাটি থেকে প্রায় ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সাল নাগাদ পুরো অর্থ পাওয়ার কথা রয়েছে। এর বাইরে সংস্থাটি থেকে সম্প্রতি আরও ৩০০ কোটি ডলার ঋণের আবেদন করে বাংলাদেশ। চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা ও নতুন ঋণের বিষয়ে দরকষাকষি করতে ৩ ডিসেম্বর থেকে আইএমএফ গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রো ইকোনমিকসের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করছে। মিশনটি চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে অনেকটা ঐকমত্যে পৌঁছালেও নতুন ঋণের বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রে কঠিন শর্ত আরোপের কথা বলছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ঋণের শর্ত হিসেবে রাজস্ব আদায় ও নীতি গ্রহণ সংস্থাকে আলাদা করতে হবে। কারণ একই প্রতিষ্ঠান দুই কাজ করার জন্য অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে ছাড় দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ থাকে। এ জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারও এটি করতে চায়। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে আরও শক্তিশালী করে আলাদা সচিব নিয়োগ দেওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। যার নেতৃত্বেই হবে রাজস্ব সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন। আর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রাজস্ব আহরণের দায়িত্বে থাকবে।
বর্তমানে একজনই অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তবে কর্মকর্তারা বলেছেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সে উচ্চতায় নিয়ে যাওয়াটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আবার এনবিআরও এটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করতে চায় না। তাই এটি কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তা ছাড়া নতুন ঋণের শর্তে করছাড় আরও কমিয়ে আনার পাশাপাশি ভ্যাটহার এক স্তরে নামিয়ে আনার বিষয়টিও থাকছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে ভর্তুকির চাপ কমিয়ে আনতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মতো জনসম্পৃক্ত কঠিন শর্তও সংযুক্ত করার কথা রয়েছে। তবে সরকার অন্তত আগামী জুন পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায় না। এর বাইরে আরও কিছু শর্তের পাশাপাশি চলমান ঋণ কর্মসূচির শর্তগুলোও অব্যাহত থাকবে। এদিকে, আইএমএফের শর্ত পরিপালনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কিনছে ডলার। এর প্রভাবে দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকা ডলারের দর বাড়ছে। বিদেশী এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে এখন ১২৫ টাকা ৪০ পয়সা দরে ডলার কিনছে কোনো কোনো ব্যাংক। অবশ্য বাজার থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেনার পাশাপাশি রমজান সামনে রেখে আমদানি বৃদ্ধিও ডলারের দর বৃদ্ধির একটি কারণ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে ডলারের বাড়তি দর মূল্যস্ফীতির ওপর আরও চাপ তৈরি করতে পারে। ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, আইএমএফের শর্ত মেনে চলতি ডিসেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত ডলার কেনা হচ্ছে। আবার রমজান সামনে রেখে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এলসি খোলায় উৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে দেশের মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে। এ সময় ডলারের দর আরও বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়তে পারে। যে কারণে ডলারের দরে খুব একটা ওঠানামা হোক, তা চায় না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ডলার দরে ওঠানামা না থাকায় প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ।