দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার ৮২ টি ব্যাংক হিসেবে প্রায় ৫৪৮ কোটি টাকা লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি। একইরকমভাবে অবৈধ উপায়ে প্রায় ১১ কোটি টাকা আয়ের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বিরুদ্ধেও। শুধু তাই নয় অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানের দুর্নীতির বিষয়েও অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। দুর্নীতি করে কেউ ছাড় পাবে না উল্লেখ করে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বুধবার দুদক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়ে মো. আক্তার হোসেন বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো আমলাই রেহাই পাবে না। টিআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থার ভাষ্যমতে ও গণমাধ্যমে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের নিস্পৃহতার বিষয় বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এসেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন সোপানের যে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট এবং বস্তুনিষ্ঠ অভিযোগ কমিশনে দাখিল হলে বা কমিশনের নজরে এলে এ বিষয়ে কমিশন দ্রুত যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ক্যাডার বা ব্যক্তির প্রতি কোনো ধরনের আনুকূল্য দেখানোর সুযোগ নেই। কমিশন প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এ বার্তা দিতে চায়।
এসময় নিজাম হাজারী-দুর্জয়ের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, নিজাম হাজারীর ৮২টি ব্যাংক হিসাবে ৫৪৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক অসংখ্য লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ১৮ কোটি ৭২ লাখ ৮৪ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে দুদক। তিনি জানান, নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি করেন সংস্থাটির উপ-পরিচালক মোহা. নূরুল হুদা। তিনি বলেন, আসামির বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭ (১), মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪ (২), ৪ (৩) ধারায় ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ৫ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, নিজাম হাজারীর ৮২ ব্যাংক হিসাবে ২৮০ কোটি ১৪ লাখ টাকা জমা ও ২৬৮ কোটি ৬৬ টাকা উত্তোলন করেছেন। তার ব্যাংক হিসাবে এখনো ১২ কোটি ৬১ লাখ টাকা জমা আছে।
অন্যদিকে নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বিরুদ্ধে ১১ কোটি ২১ লাখ ৮১ হাজার ৭৯০ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি করেন সংস্থাটির পরিচালক মো. আবুল হাসনাত।
দুর্জয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারা তৎসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। সাবেক এই ক্রিকেটার অসদাচারণ করে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেডের কাছ থেকে ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে দুর্জয় ও নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয়, তার স্ত্রী ফারহানা রহমানের ব্যাংক হিসাব তলব করে সংস্থাটি।
নিজাম উদ্দিন হাজারী বিগত ৩ সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে জয়লাভ করেছেন। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঢাকা, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলায় নামে-বেনামে জমি, বাণিজ্যিক ভবন কেনা, বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
অপরদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানের দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। অভিযোগ অনুসন্ধানে বুধবার তিন সদস্যের অনুসন্ধান টিমও গঠন করা হয়েছে।
এ বিয়ষেষবিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়াসহ অর্থপাচারের অভিযোগ রয়েছে। গত ১৯ জিয়াউল আহসান তার স্ত্রী-সন্তান এবং তাদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আক্তার হোসেন বলেন, জিয়াউল আহসান ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশম এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন পাওয়া জিয়াউল সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষিত কমান্ডো ও প্যারাট্রুপার ছিলেন। ২০০৯ সালে মেজর থাকাকালে তিনি র্যাব-২ এর উপঅধিনায়ক হন। সেই বছরই তিনি পদোন্নতি পেয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হন এবং র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার পরিচালকের দায়িত্ব পান। র্যাবে দায়িত্ব পালনের সময় থেকেই জিয়াউল আহসান হয়ে উঠেছিলেন গণমাধ্যমে পরিচিত নাম।
কর্নেল পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক করে তাকে র্যাবেই রেখে দেওয়া হয়। আর ২০১৬ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে জিয়াউল আহসানকে পাঠানো হয় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) পরিচালকের দায়িত্বে। ২০১৭ সালে এনটিএমসির পরিচালক করা হয় জিয়াউল আহসানকে। ২০২২ সালে সংস্থাটিতে মহাপরিচালক পদ সৃষ্টির পর তাকেই সংস্থাটির নেতৃত্বে রাখা হয়েছিল।
আর কে