ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২ পৌষ ১৪৩১

কূটনৈতিক দেওলিয়ায় ভারত

আবদুর রহিম

প্রকাশিত: ০২:২৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪

কূটনৈতিক দেওলিয়ায় ভারত

কূটনৈতিক দেওলিয়ায় ভারত

কূটনৈতিক দেওলিয়ার পরিচয় দিচ্ছে ভারত সরকার। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশটি একের পর এক কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করছেন। কখনো বাংলাদেশের অভ্যান্তরীন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, কখনো ভূখণ্ড নিয়ে কথা বলছেন।

তাদের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও বিভক্ত করা হচ্ছে। সবশেষ সোমবার বাংলাদেশের  একাত্তরের বিজয়কে ভারতের ঐতিহাসিক জয় দাবি করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ নিয়ে বাংলাদেশের কূটনিতিক বিশেষজ্ঞ ও প্রথম সারির রাজনীতিবিধরা বলছেন,  ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের একাত্তরের বিজয় নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন সেটা অবশ্যই হাস্যকর। যা কূটনৈতিক শিষ্টাচারে মধ্যে পড়ে না।

উগ্রবাদী এবং কী হিন্দুত্ববাদী বিশিষ্ট নিয়ে বিজেপি যে রাজনীতি করে মোদীর বক্তব্যের মাধ্যমে তা আবারও প্রমাণ হলো। বিশেষ করে দু'দেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র নীতির দেওয়া বক্তব্যও দ্বিখণ্ডিত হলো বলে মনে করা হচ্ছে।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে শক্তিশালী কূটনীতি অবস্থান নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পর এই প্রথম কোন বাংলাদেশি সরকার তাদের নিজেদের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছেন। এর ফলে নতজানু হতে বাধ্য হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত।

গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও ভারত বাংলাদেশের বিষয়ে সম্পর্ক কী হবে স্পষ্ট করেছেন। এতে করেই ভারতের ক্ষুব্ধতা বাড়ে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের নতুন সরকার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাদের শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

গত ৪ মাসে সরকারের নানা পদক্ষেপ বুঝতে পেরে বাংলাদেশ নিয়ে ভারত সরকার হিংসাত্মক ঘৃণা ছড়াচ্ছেন। ড. ইউনুস সরকারও ছাত্র জনতার রক্তস্রোতে পাওয়া বিজয় রক্ষায় কোন ছাড় দেবেন না বলে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছেন বলছেন কূটনৈতিক সূত্রগুলো। 

জানতে চাইলে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ও সাবেক মন্ত্রী ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী একাত্তরের বিজয় নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারে পড়ে না। আমি আশা করছি বর্তমান সরকার শীঘ্রই এটি অফিসিয়ালি জবাব দেবেন।

জোষ্ঠ এই রাজনীতিবিদ বলেন, আমার মনে হয় মোদি সাহেব বাংলাদেশ নিয়ে বুঝে শুনে কথা বলছেন না। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। ভারতের পরিকল্পনা ছিলো, পাকিস্তানকে দ্বিধা বিভক্তি করা সেটা তারা করতে সফল হয়েছে। শুরু থেকেই বাংলাদেশ চেয়েছে স্বাধীনতা, আর ভারত চেয়েছে পাকিস্তানকে দু' টুকরো করা। এটা ভারতের লালিত স্বপ্ন ছিলো। 

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন,  ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের একাত্তরের বিজয় নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন সেটা অবশ্যই হাস্যকর । আসলে বাংলাদেশ থেকে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার এভাবে পালিয়ে যেতে হবে তারা সেটা ভাবতে পারেননি। এজন্য এখন উলোট পালোট কথা বলছেন, যেগুলো অবশ্যই রাষ্ট্রের মৌলিক অস্তিত্ব ও কূটনৈতিক নিয়মের সাথে যায় না । মোদির  দাবিগুকূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বলেও মনে হচ্ছে। দেশের একজন প্রধানমন্ত্রীকে আরও ভেবেচিন্তে কথা বলা উচিত বলে আমি মনে করি। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, প্রথমত এখানে দেখা দরকার বিজেপি যে রাজনীতি করে উগ্রবাদী এবং কী হিন্দুত্ববাদীর যা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের ৭১ এর বিজয় নিয়ে বক্তব্যের মাধ্যমে আরেকবার সামনে এসেছে। ভারত সবসময় বলার চেষ্টা করেছে একাত্তরের যে বিজয়টা সেটা মূলত ভারত এবং পাকিস্তানের লড়াই। সে রাজনীতির অংশটুকু আবার সামনে এসেছেন তারা। কিন্তু এখন দেখার বিষয় হচ্ছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভারত বাংলাদেশের জনগণের সম্পর্ক নিয়ে যে বক্তব্য দিয়ে গেছেন সেই বক্তব্যের সাথে অবশ্যই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্য সাংঘর্ষিক । এতে করে অবশ্যই কূটনৈতিক বিষয়ের যে শিষ্টাচার গুলো সেটা ভঙ্গ হলো।  

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মোদির বক্তব্যের মাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি যে বক্তব্য যে ইচ্ছা -আকাঙ্ক্ষা সেটি কখনোই পূরণ হবে না । ভারতের একটা অংশ যেমন উগ্রবাদী হতে পারে উত্তেজনা ছড়াতে পারে ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের একটা অংশ খুব ঘৃণা ভরে বিষয়গুলা মোকাবেলা করবে। এতে করে বিজিবির যে রাজনীতি সেটা অবশ্য গ্রহণযোগ্যতা জায়গায় থাকবে না। এই ধরনের কথাবার্তা দিয়ে কখনো রাজনীতির সেতুবন্ধন হতে পারে না। কূটনৈতিক রক্ষাও হতে পারে না। আমার মনে হচ্ছে মোদির বক্তব্যের মাধ্যমে ভারত নিজেদের ক্ষতি করল একটা দেওলিয়ার পরিচয় স্পষ্ট করলো। 

বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেছেন, ভারত কূটনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপের কাছে বন্ধুহীন হয়ে গেছে ভারত। বাংলাদেশের জনগণও ভারতের সাথে নেই। কারণ ভারত শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কিছু চেনে না। শেখ হাসিনাকে ভারতে রেখে তারা পাগল হয়ে গেছে। 

গতকাল সোমবার একাত্তরের বিজয়কে ভারতের ঐতিহাসিক জয় দাবি করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি  সোশ্যাল মিডিয়ায় বলেছেন, ১৯৭১ সালে এই বিজয় দিবসে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছিল ভারত। ভারতের সেই ঐতিহাসিক জয়ে সাহসী সৈনিকদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাই।

তিনি বলেন, আজ বিজয় দিবসে, আমরা ১৯৭১ সালে ভারতের ঐতিহাসিক বিজয়ে অবদান রাখা সাহসী সৈনিকদের সাহস এবং আত্মত্যাগকে সম্মান জানাই। তার দাবি, তাদের নিঃস্বার্থ নিবেদন এবং অটল সংকল্প আমাদের জাতিকে রক্ষা করেছে এবং আমাদের গৌরব এনে দিয়েছে।এই দিনে তাদের অসাধারণ বীরত্ব এবং তাদের অদম্য চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাদের আত্মত্যাগ চিরকাল প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের জাতির ইতিহাসে গভীরভাবে গেঁথে থাকবে।

মোদির ওই ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট যুক্ত করে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল লিখেন ‘তীব্র প্রতিবাদ করছি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ছিল বাংলাদেশের বিজয়ের দিন। ভারত ছিল এই বিজয়ের মিত্র, এর বেশি কিছু নয়।’

এছাড়া বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননার শামিল।

আশিকুর রহমান

×