ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২ পৌষ ১৪৩১

নরেন্দ্র মোদির বিজয় দিবসের বিবৃতি: ইতিহাসের অপমান নাকি রাজনৈতিক কৌশল?

প্রকাশিত: ১৭:৪৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

নরেন্দ্র মোদির বিজয় দিবসের বিবৃতি: ইতিহাসের অপমান নাকি রাজনৈতিক কৌশল?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজয় দিবস উপলক্ষে দেওয়া বিবৃতি নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এতে তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহস, আত্মত্যাগ এবং ভারতের গৌরবের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে পুরো বিবৃতিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, লাখো মানুষের আত্মত্যাগ এবং স্বাধীনতা অর্জনের প্রসঙ্গ একবারও উল্লেখ করেননি।

 

বিগত বছরগুলোতে বিজয় দিবস এলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশটির সশস্ত্র বাহিনী, ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও বিরোধী রাজনীতিকদের অনেকেই ‘বিজয় দিবস’কে স্মরণ করেছেন। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও এদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট (টুইট) করেন। তবে ‘বিজয় দিবস’ উপলক্ষে করা সেই ভার্চুয়াল বার্তায় কোথাও দেখা যায় না বাংলাদেশের নাম। এমনকি মুক্তিবাহিনী, এদেশের মানুষের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের গল্পও থাকে উপেক্ষিত।

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, পুলিশ, সৈন্য, নারী-পুরুষসহ দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় প্রাণ দিয়েছিলেন প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। দুই লাখের বেশি নারী পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হন।

মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে সরাসরি সহায়তা করে, যা স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত করে। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মূল চালিকা শক্তি ছিল বাংলাদেশের জনগণের আত্মত্যাগ।

 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিবৃতিতে এ যুদ্ধকে ভারতের "ঐতিহাসিক বিজয়" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং লাখো মানুষের আত্মত্যাগের কথা একেবারে উপেক্ষিত। এতে প্রশ্ন উঠেছে—এই যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস কি ভারতের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়েছে?


বাংলাদেশকে একটি সহায়ক ভূমিকায় দেখানোর প্রবণতা ভারতের সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং নীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। এই বিবৃতি ভারত সরকারের ভাবনার একটি ইঙ্গিত মাত্র। নরেন্দ্র মোদির বিবৃতিকে কেবল তার ব্যক্তিগত মত হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এটি ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। এ ধরনের বক্তব্যে ভারত নিজেদের ভূমিকাকে উচ্চকিত করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। এই বিবৃতি কৌশলগত। এতে বাংলাদেশের আত্মত্যাগ এবং জনগণের ভূমিকা মুছে ফেলে ভারত নিজেদের বিজয়ের একক কৃতিত্ব দাবি করছে।

 

নরেন্দ্র মোদির বিবৃতি কেবল একটি পোস্ট নয়; এটি ইতিহাসের ওপর এক ধরনের রাজনৈতিক পুনর্লিখনের প্রয়াস। বাংলাদেশের জনগণের আত্মত্যাগ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার দায়িত্ব এ দেশের নাগরিকদের। বাংলাদেশের ইতিহাসের এই বিকৃত উপস্থাপনা শুধু অস্বীকার নয়, এটি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক কৌশল। এর বিরুদ্ধে সজাগ থাকা জরুরি, যাতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছায়।

 

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর দীর্ঘকাল ধরে যে রাজনৈতিক প্রভাব এবং আধিপত্য ভারত গড়ে তুলেছিল, তা বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক লহমায় ভেঙে পড়েছে। দিল্লি হয়তো কল্পনাও করেনি যে, তাদের দীর্ঘমেয়াদী মিত্র দেশটি একদিন এমন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে ভারত সরকারের মধ্যে এক ধরনের হতাশা দেখা যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো, যেমন শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং মালদ্বীপেও ভারতের প্রভাব কমে আসছে।  এরইমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজয় দিবস উপলক্ষে দেওয়া বিবৃতি নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

তাবিব

×