গেল এক দশকে ক্যান্সারের টেস্ট, এন্ডোটক্সিন টেস্ট, নিউরোঅপটিক্যাল এনএমও, এমওজি টেস্ট, করোনার এন্টিবডি টেস্টসহ প্রায় দুই শতাধিক মলিকুলার টেস্টের সক্ষমতা অর্জন করে সরকারের স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্ট-বিআরআইসিএম। দেশেই এসব টেস্ট চালুর পর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আর পাঠাতে হতো না। এতে বছরে ৯৬০ কোটি টাকারও বেশি সাশ্রয় হতো বাংলাদেশের। আর এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে ভারতপ্রেমীরা। শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের ষড়যন্ত্র।
গত ৫ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিধি বহির্ভূতভাবে জোরপূর্বক প্রথমে সরিয়ে দেওয়া হয় দুই শতাধিক মলিকুলার টেস্টের সক্ষমতা অর্জনের মূল কারিগর প্রতিষ্ঠানটির সাবেক মহাপরিচালক (অতিরিক্ত) মালা খানকে। একে একে অধিকাংশ টেস্ট বন্ধ করে দিয়ে আবারও সাধারণ মানুষকে করা হচ্ছে ভারতমুখী। আর এতে প্রতিবছর ৯৬০ কোটি টাকারও বেশি ভারতে চলে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত হচ্ছে।
অনুসন্ধান বলছে, বিআরআইসিএম ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ এর কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসে মরিয়া ছিল আগে থেকেই। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রভাবশালী এক অতিরিক্ত সচিবসহ ছাত্রলীগ থেকে আসা প্রতিষ্ঠান দুটিতে নিয়োগ পাওয়া কয়েকজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রের জাল পাতে। এসব বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রমাণ রয়েছে প্রতিবেদকের হাতে। তাদের চাকুরিতে যোগদান প্রক্রিয়ার জালিয়াতির তথ্যও রয়েছে প্রতিবেদকের হাতে। কেমিক্যাল মেট্টোলজি বিষয়ে সরকারের একমাত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইআরসিএম-এর প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী এবং মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন মালা খান। তার নেতৃত্বেই মলিকুলার টেস্টের সক্ষমতা অর্জন করে এই প্রতিষ্ঠান।
একদিকে ভারতের ভিসা বন্ধ, অপরদিকে বিআরআইসিএম-এর গবেষণা কার্যক্রমও প্রায় বন্ধ। ফলে সক্ষমতা প্রমান করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উপযুক্ত সময় যখন, তখনই প্রায় অকেজো এই প্রতিষ্ঠান। আজ চরম বিপদে পড়েছে দেশের লাখ লাখ মলিকুলার টেস্ট গ্রহণকারী।
অনুসন্ধান বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ থেকে আলাদা হওয়ার পর সকল নিয়োগ বর্তায় বিআরআইসিএম উপর। কিন্তু তা উপেক্ষা করে অনাধিকার চর্চা করে জোরপূর্বক বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ কর্তৃপক্ষ নিয়োগ দেয় ৯ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। মালা খানের পিএইচডি গবেষণা সার্টিফিকেট জালিয়াতি, আর্থিক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ এবং তার যেসব সম্পদের ফিরস্তি তুলে ধরে অভিযোগ তোলা হয়েছে তার কোন সত্যতা মেলেনি আজও।
তিনি বলেন, ইতঃপূর্বে বিভিন্ন মিডিয়ায়, সভায় ও নানাভাবে তার বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্য প্রকাশ করায় তিনি সিএমএম আদালতে বিসিএসআইআরের কতিপয় বিজ্ঞানীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তের অপেক্ষায় রয়েছে।
মালা খান বলেন, ৫ আগস্টের সাথে তার বিষয়ে কোনো সম্পর্ক নেই, তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের সদস্যরাই অনেক আগে থেকেই ষড়যন্ত্র করছে। তাদের কোনো অভিযোগই সত্য প্রমাণিত হয়নি। অবশেষে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে একটি মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে একটি চক্র তার কাছে গিয়ে জোরপূর্বক মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিপত্রে স্বাক্ষর গ্রহণ করিয়ে নিয়েছে। ওই সময় তিনি হাসপাতালে তার অসুস্থ বাবার পাশে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের উপযুক্ত তদন্ত করে পাশাপাশি এসব ঘটনারও তদন্ত চেয়েছেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা অভিযোগ করেছে তারা প্রকাশ্যে কেন কথা বলছে না। অভিযোগে তারা এনেছে, এই প্রতিষ্ঠান থেকে শত কোটি টাকা দুর্নীতি করেছি। অথচ গত ১৪ বছরে এই প্রতিষ্ঠানের ২০০ কোটি টাকাও খরচ হয়নি। তাহলে একশ কোটি টাকা দুর্নীতি করলাম কিভাবে। আমার পিএইচডি ডিগ্রী নিয়ে কথা তোলে সেটিও হাইকোর্টের মাধ্যমে একটি সমাধান ইস্যু। অথচ সেই ডিগ্রি দিয়েই এই ভবনটি গড়ে উঠেছে। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের সাশ্রয় হয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত চার বছরে ৩২ জনকে নিয়োগ দিয়েছি। নিয়োগপ্রাপ্তদের যদি কেউ বলে, নিয়োগ পেতে ৩২ পয়সা খরচ হয়েছে তাহলে আমি শাস্তি মাথা পেতে নেবো। অথচ আমাকে পদ থেকে সরানোর পর সব ধরণের মলিকুলার টেষ্ট বন্ধ রয়েছে। তাহলে কি লাভ হলো। দেশের তো বিশাল ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে।
ড. মালা খানের বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছেন রোববার (১৫ ডিসেম্বর) দুপুরে প্রতিষ্ঠানটির ল্যাবে তাদের বক্তব্য নিতে গেলে তারা জানান, যেহেতু এটি একটি ল্যাব তাই আপনারা নীচে অবস্থান করেন। আমরা নীচে আসছি। সেখানে কথা বলবো। এরপর নীচে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করলেও অভিযোগকারীদের কেউ আসেনি। এরপর আবার ল্যাবে গেলে কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে অভিযোগ অন্যান্য বেশ কয়েকজন স্বাক্ষরকারীর সাক্ষাত মেলে। তখন অনেকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। কেউ বলেন, জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। আবার কেউ বলেছেন, স্বাক্ষর অন্য কেউ করে দিয়েছে। কারা স্বাক্ষর নিয়েছে জানতে চাইলে হাসান, তাহেরসহ আরও অনেকের নাম উল্লেখ করেন।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক (ডিজি) ড. একে এম আজাদুর রহমান বলেন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ড. মালা খানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এরপর গত ১০ ডিসেম্বর নতুন পরিচালনা বোর্ড গঠনের পর বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহবায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর মন্ত্রণালয় যে ব্যবস্থা নেবে সেটাই চুড়ান্ত হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তের আগেই তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি বর্তমানে চিফ সায়েন্টিস্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ডিজি বলেন, আমি নতুন এসেছি। ওনার সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। যেহেতু তাকে নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। সেগুলো তদন্ত হোক, পুরো বিষয় পরিস্কার হবে বলে আশা করছি।
আবদুর রহিম/ফুয়াদ