ছবি: সংগৃহীত
গত কয়েক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ভারত নিজেদের প্রভাব বিস্তারে দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের নামে একতরফা সুবিধা আদায়— এসবই ভারতের আগ্রাসী কৌশলের পরিচায়ক। বাংলাদেশও এই আগ্রাসনের শিকার। তবে সময় এসেছে আমাদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার।
বাংলাদেশের জনগণ বছরের পর বছর তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য পাওনার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু ভারত সরকার এই ইস্যুতে বারবার আশ্বাস দিয়েও কার্যকর কোনো সমাধান আনতে পারেনি। বরং তারা নিজেরা একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, যা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে চাষাবাদ ও জনজীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
সীমান্ত পরিস্থিতিও কম উদ্বেগজনক নয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিয়মিতভাবে গুলি চালানো এবং হত্যার ঘটনা ঘটছে। ফেনসিডিল ও অন্যান্য মাদকের চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি প্রজন্ম ধ্বংসের পথে পরিচালিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছে। দেশের স্থানীয় শিল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ সস্তায় ভারতীয় পণ্য ঢুকিয়ে তারা আমাদের শিল্পের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা ধ্বংস করছে। এছাড়া ট্রানজিটের নামে ভারত আমাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করলেও, আমরা বিনিময়ে তেমন কোনো সুফল পাচ্ছি না।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন গুজব এবং ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা দুই দেশের সম্পর্ক এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এই ধরনের অপতথ্য প্রচারের উদ্দেশ্য শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যে প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে এবং রাজনীতির অঙ্গনে ভারতীয় কিছু চ্যানেল এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত ভুল তথ্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। একদিকে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে ভিত্তিহীন প্রতিবেদন, অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে জটিল করে তোলার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবর ও গুজব ছড়িয়েছে। এমন ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমের নাম উঠে এসেছে বাংলাদেশের তথ্য যাচাই সংস্থা রিউমর স্ক্যানারের এক প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব গণমাধ্যমে অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর প্রচারিত হয়েছে।
ভারতের গণমাধ্যম রিপাবলিক বাংলা সর্বাধিক ৫টি গুজব প্রচার করেছে বলে জানিয়েছে রিউমর স্ক্যানার। এরপর রয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ ও লাইভ মিন্ট; যারা প্রত্যেকে অন্তত তিনটি গুজব প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া রিপাবলিক, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি আনন্দ ও আজতক অন্তত দুটি করে গুজব প্রচার করেছে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির জন্য এক বড় ধরনের ধাক্কা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর দীর্ঘকাল ধরে যে রাজনৈতিক প্রভাব এবং আধিপত্য ভারত গড়ে তুলেছিল, তা বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক লহমায় ভেঙে পড়েছে। দিল্লি হয়তো কল্পনাও করেনি যে, তাদের দীর্ঘমেয়াদী মিত্র দেশটি একদিন এমন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে।
সময় এখন নিজেদের শক্তি ও মর্যাদা প্রমাণ করার। বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের দাবি তুলে ধরতে হবে এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করতে হবে।
জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় জনগণের ঐক্যই সবচেয়ে বড় শক্তি। রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারতের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।ভারতের আগ্রাসন থেকে মুক্তি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক প্রয়াস নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, আত্মমর্যাদা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার প্রশ্ন। এখনই সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
তাবিব