.
শীত নামছে। দূর-দূরান্তের দেশ থেকে আসতে শুরু করেছে পরিযায়ী পাখি। বিচিত্র পাখির ওড়াউড়ি দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের আকাশে। কিছু পাখি খুব দুর্লভ। এই দুর্লভ পাখিদেরই একটি দাগি রাজহাঁস।
‘দাগি’ আসামির কথা। হ্যাঁ, আমরা প্রচুর শুনেছি। কিন্তু দাগি রাজহাঁসের কথা শোনা হয়নি বা কম শোনা হয়েছে- তাই তো? আছে। তবে এই পাখির বেলায় ‘দাগি’ শব্দটা মন্দ অর্থে ব্যবহার হয় না। বরং মাথা ও গলায় এমন কিছু দাগ দৃশ্যমান, যা পাখির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। বিশেষ আকর্ষণীয় করে তোলে পাখিটিকে।
গবেষকদের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রায় ২০ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে দাগি রাজহাঁসের আবাস। দক্ষিণ, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। দাগি রাজহাঁস মধ্য এশিয়া থেকে উড়তে উড়তে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চলে আসে। হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এবারো এসেছে বাংলাদেশে। রংপুরে তিস্তা নদীতে দাগি রাজহাঁস দেখার খবর পাওয়া গেছে। মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশে আসার জন্য অতিক্রম করতে হয় হিমালয় পর্বত। হাঁস প্রজাতির যেহেতু, বড় শরীর। ওজন বেশি। দেড় থেকে সাড়ে তিন কেজি পর্যন্ত হয়। এর পরও ৭ হাজার মিটার উঁচু হিমালয় দক্ষতার সঙ্গে পাড়ি দেয়। জেনে অনেকে অবাক হবেন। এ জন্য হিমালয়ের ওপর দিয়ে ৮ ঘণ্টা ধরে উড়তে হয় ওদের! তবুও ক্লান্তি নেই। এভাবে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের ওপর দিয়ে উড়তে সক্ষম পাখির সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। দাগি রাজহাঁস কিভাবে এত উঁচু দিয়ে উড়তে পারে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, পাখিটির রক্তে যে লোহিতকণিকা, সেটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। লম্বা সময় অক্সিজেন ধরে রাখতে পারে। মূলত এ কারণেই অনেক উঁচু দিয়ে উড়তে সক্ষম।
অতি সম্প্রতি রংপুরে তিস্তা নদী অববাহিকায় দাগি রাজহাঁস দেখার কথা জানিয়েছেন আলোকচিত্রী রাকিন জহির। তার বর্ণনা মতে, ছবি তুলতে হামাগুঁড়ি দিয়ে পাখির একেবারে কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন তিনি। বিস্ময় চোখে দেখেছেন তিনি।
বিরল রাজহাঁসটিকে পরিণত বয়সে ধূসর দেখায়। মাথার রং সাদা। সেখানে দুটি কালোডোরা দাগ থাকে। মাথা থেকে গলার নিচ পর্যন্ত একটি সাদা সরলরেখা দৃশ্যমান হয়। উড়ন্ত অবস্থায় তোলা ছবিতে দেখা যায়, এক জোড়া পাখি একই উচ্চতায় অদ্ভুতভাবে উড়ছে। দেখে মনে হয় জেট বিমান! পেছনের বিমানটি সামনেরটিকে নিপুণভাবে অনুসরণ করছে। পাখিটির চোখ বাদামি। ঠোঁট হলুদ। পা এবং পায়ের পাতাও তা-ই। ঠোঁটের আগা কালো। নাক কালো। কপাল, গাল ও গলা অনুজ্জ্বল রঙের। মাথায় ধূসর-বাদামি চাঁদি আছে।
দাগি রাজহাঁস জলচর পাখি। এর কোনো উপপ্রজাতি হয় না। গবেষণা তথ্য মতে, পাখিটি দৈর্ঘ্যে ৭৩ সেন্টিমিটার বা এর থেকে সামান্য কম-বেশি হয়ে থাকে। ডানা ৪৫ সেন্টিমিটারের মতো। ঠোঁট প্রায় ৫ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার। লেজ ১৪ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার। ৭ দশমিক ১ সেন্টিমিটার পা।
এখন কথা হচ্ছে, দুর্লভ পরিযায়ী পাখি কতটা আতিথেয়তা পাচ্ছে বাংলাদেশে? উত্তর জেনে মন খারাপ হয়ে যাবে পাখিপ্রেমীদের। রাকিন জানাচ্ছেন, কাক, দাঁড়কাক, শিয়াল, গাঙচিল, ঈগল এদের গিলে ফেলার চেষ্টা করে সব সময়। তবে তার চেয়ে ভয়াবহ তথ্য এই যে, তিস্তাপাড়ের কিছু দুষ্টু লোক পাখির খাবারের সঙ্গে এক ধরনের বিষ মিষিয়ে দিচ্ছে! নিজ চোখে তিনি তা দেখেছেন। অথচ বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এ কারণে পাখিটির সংখ্যা আরও কমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। এটা সত্যি হতাশার। প্রতিবছর শীত শেষে বসন্তে ফিরে যায় পাখিটি। এবারো ফিরে যাবে। যেন তারা ঠিক ঠিক ফিরে যেতে পারে- আমাদের তা-ই চাওয়া।