ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

দূষণে নতুন রেকর্ড, একিউআই উঠছে ৪শ’-এর ওপরে

বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ঢাকার বাতাস

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:০২, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ঢাকার বাতাস

শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই ধুলায় ধূসর রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা

ঢাকার বাতাস ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। গত সোমবার (৯ ডিসেম্বর) রাতে ঢাকার বায়ুদূষণ নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে। এদিন রাত ১০টায় আইকিউএয়ার সূচকে একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) পৌঁছায় ৪৫৭-এ। শুধু তাই নয়, সন্ধ্যা ৮টা থেকে টানা ৫ ঘণ্টা এই সূচক ৪০০-এর বেশি ছিল।
একিউআই সূচক অনুযায়ী, ১৫১-২০০ ‘অস্বাস্থ্যকর,’ ২০১-৩০০ ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০০-এর বেশি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে ধরা হয়, যা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। সেখানে সোমবার রাতে ঢাকার বাতাসের একিউআই সূচক ৪০০-এর ওপর উঠে যায়। অথচ এই সূচক ৩০০-এর ওপর গেলেই ওই বায়ুকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেছেন, ‘সম্প্রতি একিউআই ৩০০ ছাড়ালেও এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ ছিল না। আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ বিবেচনা করছি, যার মধ্যে দূষণজনিত ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে ঢাকায় স্কুল বন্ধ রাখা এবং একিউআই ২৫০ ছাড়ালেই মোবাইলে সতর্কবার্তা পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।’
এ কারণেই মঙ্গলবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় ঢাকাবাসীর জন্য সতর্কতা জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকার বায়ুমান বর্তমানে মাঝে মাঝে অস্বাস্থ্যকর থেকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছাচ্ছে (একিউআই>২৫০)। এ অবস্থায় সবাইকে বাইরে গেলে মাস্ক পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সংবেদনশীল ব্যক্তিদের অতি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) সূচক অনুযায়ী, বুধবারও ঢাকার বাতাস ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। এদিন রাজধানী ঢাকার দূষণ স্কোর ছিল ২৩৬ অর্থাৎ এখানকার বাতাসও খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় আছে।
এদিন দূষণ তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করা পাকিস্তানের লাহোরের দূষণ স্কোর ২৮২ অর্থাৎ সেখানকার বায়ু খুবই অস্বাস্থ্যকর। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারতের কলকাতা এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা।
পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান কারণ বর্জ্য পোড়ানো, উন্নয়ন কাজ, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইটভাঁটি এবং সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আসা দূষিত বাতাসসহ অন্যান্য কারণ।
দুই সিটি করপোরেশন অভিযোগ জানিয়েছে, উন্নয়ন কাজ থেকে তৈরি হওয়া দূষণ তাদের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। পানি ছিটানো ও শহর পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য তাদের যানবাহনের সংখ্যা সীমিত। পানির সরবরাহ কম থাকায় খুব সীমিত পরিমাণে পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে।
কুড়িল এলাকার বাসিন্দা হাবিবুল্লাহ বলেন, গত কয়েকদিন ধরে আমাদের এলাকায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমার বাড়ি প্রগতি সরণি রোডের কাছাকাছি এবং এই রাস্তাটি অফিসে যাওয়ার জন্য নিয়মিত ব্যবহার করি। আমাদের পরিবারের চার সদস্যই সর্দি-কাশিতে ভুগছি। আমার তিন বছরের শিশুকে এখন বায়ুদূষণজনিত রোগের কারণে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করলেও, ধুলার প্রকোপ থেকে বাঁচতে পারি না। আমার অ্যাজমা সমস্যা গত কয়েকদিনে বেড়েছে এবং ডাক্তার বলেছে, এমন বায়ুদূষণের মধ্যে ঘরের বাইরে না যেতে। কিন্তু না গিয়ে তো সম্ভব না। বাসার জানালা সবসময় বন্ধ থাকলেও রুমে ধুলা জমে যায়।
বাড়ছে বায়ুদূষণজনিত রোগীর সংখ্যা ॥  বায়ুদূষণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুসহ সব বয়সী মানুষের অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন ধরনের শ্বাসতন্ত্রের রোগ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
দুই মাস আগেও শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের আউটডোরে দিনে গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ রোগী চিকিৎসা নিতেন। এখন তা বেড়ে ৫০০ হয়েছে। ইনডোরে বর্তমানে ভর্তি আছেন ১০০ রোগী, অন্যান্য সময় যা অনেক কম থাকে।
শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, ‘সিজন পরিবর্তন, বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়ায় এখন হাঁচি-কাশি ও অ্যাজমার রোগী অনেক বেড়ে গেছে।’
বাংলাদেশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রোগী ফুসফুসের বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশ অ্যাজমা অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে শুধু অ্যাজমাতে আক্রান্ত ৭০ লাখ মানুষ।
প্রতিরোধমূলক ওষুধ বিশেষজ্ঞ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিন বলেন, বায়ুদূষণের স্বল্পমেয়াদি প্রভাবের মধ্যে রয়েছে হাঁচি, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। আর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, মাথা ঘোরা, ফুসফুসের প্রদাহ, যক্ষ্মা, ফুসফুসের ক্যান্সার, অপরিণত শিশুর জন্ম এবং পুরুষ ও নারীর উভয়ের ক্ষেত্রে বন্ধত্বের ঝুঁকি বৃদ্ধি।
তিনি বলেন, ‘বায়ুদূষণ কমাতে হলে হাইকোর্টের যে নির্দেশনা আছে সেটি আপাতত বাস্তবায়ন করতে হবে। শহরের মধ্যে কোনো ইন্ডাস্ট্রি থাকবে না, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে, মোটর গাড়ির ইঞ্জিন ঠিক রাখতে হবে, জ্বালানি যেন মানসম্মত হয় এবং ঢাকার চারপাশে যে ইটভাঁটি আছে, তা একটু সরিয়ে নিতে হবে।’
তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিদিন বায়ুর মান কেমন, তা জানানো উচিত। এ ছাড়া, অস্বাস্থ্যকর দিনে জনসাধারণকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া উচিত, প্রয়োজনে স্কুল বন্ধ রাখা এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের বাইরের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা উচিত।
ঢাকা কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরামর্শক (মেডিসিন) ডা. আশরাফুল ইসলাম ইরফান বলেন, বায়ুদূষণ থেকে সুরক্ষার জন্য বাইরে থাকাকালে মাস্ক পরা এবং নিয়মিত হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি। হাঁপানি রোগীরা দূষণের কারণে মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হন। তাদের উচিত ইনহেলার ব্যবহার করা, মাস্ক পরা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা নেওয়া।
গত ৯ বছরে বায়ুদূষণে শীর্ষে বাংলাদেশ ॥ স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাটমসফেরিক পলিউশন স্টাডিজ (সিএপিএস)-এর এক গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে, ২০১৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার হয়েছে।
গত আট বছরে (২০১৬-২০২৩) নভেম্বরে ঢাকার গড় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ছিল ১৭৬.৬৬। তবে এ বছরের নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৫। এটি গত ৯ বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি এবং ২০২৩ সালের তুলনায় ১১.৫ শতাংশ।
সিএপিএস-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘গত নভেম্বরে ঢাকার বাসিন্দারা একদিনও নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে পারেননি। একদিন বায়ুমান ছিল মাঝারি, সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য চারদিন ছিল ‘ঝুঁকিপূর্ণ’, বারো দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ১৩ দিন ছিল ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর।’ এমন পরিস্থিতিতে যখন একিউআই ৩০০ ছাড়িয়ে যায়, তখন সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা উচিত।
কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া ॥ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার নাগরিকদের বাইরে মাস্ক পরার আহ্বান জানিয়েছে এবং সংবেদনশীল ব্যক্তিদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
এ ছাড়াও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার অনুরোধ করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে ইটভাঁটি, শিল্প-কারখানার মালিক এবং সাধারণ মানুষকে কঠিন বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ রাখা, নির্মাণস্থলে ছাউনি ও বেষ্টনি স্থাপন করা, নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ট্রাক বা লরি ঢেকে নেওয়া, নির্মাণস্থলের আশপাশে দিনে দুইবার পানি ছিটানো, পুরনো ও ধোঁয়া তৈরি করা যানবাহন রাস্তায় বের না করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেছেন, সম্প্রতি একিউআই ৩০০ ছাড়ালেও এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ ছিল না। আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ বিবেচনা করছি, যার মধ্যে দূষণজনিত ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে ঢাকায় স্কুল বন্ধ রাখা এবং একিউআই ২৫০ ছাড়ালেই মোবাইলে সতর্কবার্তা পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সব মন্ত্রণালয়কে সতর্ক থাকার এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বারবার অনুরোধ করা হলেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ে জানা গেছে, তাদের চারটি রোড সুইপার এবং ৯টি পানি ছিটানোর গাড়ি রয়েছে। তবে দূষণের চরম সময়েও কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন-এর পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. খায়রুল বকর বলেন, আমাদের ৫ হাজার লিটারের চারটি এবং ৭ হাজার লিটারের পাঁচটি পানি ছিটানোর গাড়ি আছে। কিন্তু পানির স্বল্পতার কারণে প্রয়োজন অনুযায়ী ছিটানো সম্ভব হচ্ছে না। ওয়াসা প্রতিদিন যথেষ্ট পানি সরবরাহ করে না, আর খাল বা নদীর দূষিত পানি ব্যবহার করা যায় না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একই বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার খোন্দকার মাহবুব আলম বলেন, ‘আমাদের দশটি পানি ছিটানোর গাড়ি আছে, যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ফলে আমরা পালা করে বিভিন্ন এলাকায় পানি ছিটাই। প্রতিটি রাস্তায় সকালবেলায় একবার পানি ছিটানো হয়। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা আবার ধুলায় ঢেকে যায়। রাস্তা সবসময় ভেজা রাখা বাস্তবসম্মত নয়।’

জোবায়ের আহমেদ

×