২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ভয়াবহ দিন। বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন আইভি রহমানসহ ২৪ জন, আহত হন শতাধিক। এই ঘটনা জাতির ইতিহাসে এক গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে, এমন ঘটনা কোনো কালেই কোনো ভাবেই কাম্য নয়। তবে এই ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া এবং পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি উচ্চ আদালতের রায়ে মামলার আসামিরা খালাস পাওয়ার পর ঘটনাটি নতুন আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে এই মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
ঘটনার পর চারটি মামলা দায়ের করা হয়, যার মধ্যে তিনটি আওয়ামী লীগ করে এবং একটি মামলা পুলিশের পক্ষ থেকে করা হয়। ২০০৮ সালে দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক আইনে দেওয়া অভিযোগপত্রে আসামি করা হয় ২৮ জনকে। মুফতি হান্নান তখন একটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তবে এই অভিযোগপত্রে তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর বা অন্য কোনো উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম ছিল না। এখানেই রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ, প্রথমে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও পরে কেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এটা নিশ্চয়ই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিফলন।
বিচার কার্যক্রমের শুরুতে রাষ্ট্রপক্ষ ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করে। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন, যদিও তখনকার তদন্ত কর্মকর্তারা এমন কোনো আবেদন করেননি। আদালত এই আবেদন মঞ্জুর করেন এবং নতুন তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহহার আকন্দকে দায়িত্ব দেন। খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় মামলার মোড় ঘুরানোর প্রচেষ্টা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেই করা হয়।
নতুন তদন্ত কর্মকর্তা মুফতি হান্নানকে ফের রিমান্ডে নিয়ে ৪০০ দিন আটক রাখেন। এই সময়ে তিনি দ্বিতীয় দফায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এই জবানবন্দির ভিত্তিতে তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ২৯ জনকে নতুন আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও মুফতি হান্নান পরে আদালতে দাবি করেন যে, রিমান্ডে নির্যাতনের কারণে তিনি এই জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁর এই দাবিও আমলে নেওয়া হয়নি।
২০১৮ সালে দেওয়া রায়ে বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং তারেক রহমানসহ আরও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আজ সুদীর্ঘ কাল মিথ্যা অপবাদ মাথায় নেওয়া থেকে মুক্তি পেলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি সহ সকল আসামিকে খালাস দিয়েছে আদালত। আজকের এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এটা সততা ও সত্যের পথের এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আদালত বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা হয়েছে বলে সন্দেহাতীত প্রমাণ পাওয়া গেছে। আদালত আরও উল্লেখ করেছেন যে, পরস্পরের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের অভাবে এ ধরনের মামলার বিচারে ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
এই পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট আসামি মুফতি হান্নানের দেয়া দ্বিতীয় জবানবন্দির ভিত্তিতে সাজা দেয়ার বিষয়টিকে বেআইনি ঘোষণা করেছেন।আইনজীবীরা মনে করেন, ৪০০ বছরের উপমহাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের জবানবন্দির ভিত্তিতে সাজা দেয়ার নজির নেই।
এখান থেকে তিনটি বিষয় একদম স্পষ্ট হয়েছে, প্রথমত, একজন আসামীর দ্বিতীয় দফার জবানবন্দি নেওয়া বেআইনি।
দ্বিতীয়ত, একবার চার্জশিট দাখিলের পর নতুন করে তদন্তকে আদালত আইনবিরুদ্ধ হিসেবে দেখেছেন।
তৃতীয়ত, ৩টি অভিযোগপত্রে সাক্ষ্য এবং প্রমাণের মধ্যে অসংগতি। দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে যুক্ত করা প্রমাণ ও সাক্ষ্য প্রথম অভিযোগপত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, মামলার এই প্রক্রিয়াগুলো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বদলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।
এই ঘটনার বিচার নিয়ে বরাবরই রাজনৈতিক বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে। প্রথম অভিযোগপত্রে যখন তারেক রহমান বা বাবরের নাম ছিল না, তখন কীভাবে তাঁদের অভিযুক্ত করা হলো? তদন্ত কর্মকর্তা এবং বিচারক পরবর্তীতে রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই রায় তাই কেবল একটি আইনি দলিল নয়; এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার প্রশ্নও তুলে ধরেছে।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতাকে প্রলম্বিত ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল বিভাগকে ন্যাক্কারজনকভাবে ব্যবহার করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে, যার নজির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্যক্তিগত আক্রোশের জের ধরে ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিচার বিভাগকে ব্যবহার করেছে। জিয়া পরিবারের প্রতি তার বিদ্বেষ এবং হিংসাত্মক মনোভাব চরমভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সত্যেয় জয় যে অনিবার্য তা আবারো প্রকাশ পেয়েছে। ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলার অভিযোগ থেকে তারেক রহমানের মুক্তি পাওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো।
ফুয়াদ