ড্যাপ সংশোধনে ঢাকা আরও ঝুঁকিতে
ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বারবার সংশোধনের ফলে ঢাকার বাসযোগ্যতা আরও সংকটে পড়বে বলে জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলেন, ‘সম্প্রতি ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর যে সকল সংশোধনীর প্রস্তাব প্রকাশ করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সেখানে শহরের বাসযোগ্যতা, ধারণক্ষমতা, নাগরিক সুবিধাদি, পরিবেশ প্রাধান্য পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে আবাসন ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক স্বার্থ। তাই যানজট-দূষণে স্থবির ও অবাসযোগ্য ঢাকা আরও নিশ্চল হয়ে পড়বে।
এ থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পনাগত টেকসই কৌশল ও পন্থা কাজে লাগিয়ে জনস্বার্থ, বাসযোগ্যতা, জনস্বার্থ ও পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়েই ড্যাপের প্রয়োজনীয় পরিমার্জনা করতে হবে।’ বুধবার ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পর্যালোচনা বিষয়ক অনলাইন এই অনুষ্ঠানে এই মতামত দেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। মূল প্রতিপাদ্য ছিল, ‘কোন স্বার্থে ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর বারবার সংশোধনের উদ্যোগ: আইপিডি’র পর্যবেক্ষণ’।
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে আইপিডির পক্ষ থেকে পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ড্যাপ সংশোধনে রাজউকের সংশোধনীতে ভবনের আকার-উচ্চতার বাড়ানোর প্রস্তাবনা ছাড়া অন্য কিছু আসেনি। বন্যা প্রবাহ এলাকা, জলাভূমি, কৃষিজমি রক্ষার বিষয়টি উপেক্ষায় থেকেছে। আমরা বলে এসেছিলাম, আবাসন ব্যবসায়ী ও কিছুসংখ্যক পেশাজীবি ড্যাপ বাতিল বা স্থগিতের আবেদন করছে শুধু ভবন নির্মাণে বেশি এফএআর (ফার) মান বাড়ানোর জন্যই। আমাদের সেই শঙ্কাই সত্যি প্রমাণ হয়েছে। ড্যাপ সংশোধনে প্রস্তাবিত এরিয়া ফার ও ব্লকভিত্তিক ফার মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাসযোগ্য শহর নির্মাণে পরিকল্পনার ব্যকরণ অনুসরণ করা হয়নি। ফলে ড্যাপে প্রস্তাবিত সংশোধনীসমূহ ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতাকে আরু ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
আইপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, বড় শহরের জনঘনত্ব সাধারণত একরপ্রতি ১০০-১০০ জন বা প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫-৩০ হাজার হয়। এই জনঘনত্বও শহরের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু নগর এলাকায় থাকে, যা শহরের প্রান্তের দিকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে। চূড়ান্ত ড্যাপে ঢাকার অপরিকল্পিত এলাকা জিনিজিরার জনঘনত্ব কাঠাপ্রতি পরিবারসংখ্যা ১.২ বা একরপ্রতি ১৫০ দেওয়া থাকলেও ১৮ নভেম্বর এ রাজউক প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ১৫০ শতাংশ বেড়ে কাঠাপ্রতি পরিবারসংখ্যা ৩.০ বা একরপ্রতি প্রায় ৩৫০ জন প্রস্তাব করা হয়েছে। এই এলাকার আগে প্রস্তাবিত এফএআর মান ১.৩ থেকে ১৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি করে প্রস্তাব করা হয়েছে ৩.৩।
একইসঙ্গে ওয়েবসাইটে আপলোডকৃত প্লটভিত্তিক ফার সূচকে অ৩ (ফ্ল্যাট ও এপার্টমেন্ট বাড়ি) ক্যাটাগরির ফার মানসমূহ যেভাবে অপরিপক্কভাবে কেটে দিয়ে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, তা দুরভিসন্ধিমূলক। ব্লক ডেভেলপমেন্ট এর ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক ফার বোনাস সাধারণত ১৫ - ২০ শতাংশ হয়ে থাকে। অথচ রাজউক এলাকাভিত্তিক ফার মান এর তুলনায় ব্লকভিত্তিক ফার মান ৯০ -১২০ শতাংশ বাড়িয়ে প্রস্তাব করেছে, যা বৈশ্বিক পরিকল্পনা কৌশলের সাথে সাংঘর্ষিক। এভাবেই অনেক এলাকারই ফার মান অযাচিতভাবে বেড়েছে। ফলে এসব এলাকার বাসযোগ্যতা আরও সংকটে পড়বে বলে মনে করে আইপিডি। বক্তারা বলেন, ব্যবসায়ী ও স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে ড্যাপ (২০২২-৩৫) চূড়ান্ত হবার দুই বছরের মধ্যে দুইবার ড্যাপ সংশোধন এর উদ্যোগ নেওয়া হলো।
ড্যাপ সংশোধন প্রক্রিয়ায় রাজউকের কতিপয় কর্মকর্তা ও পেশাজীবীদের এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। বাসযোগ্যতার তলানিতে থাকা ঢাকা শহর থেকে ব্যবসায়িক মুনাফা ও গোষ্ঠীস্বার্থকে প্রাধান্য দেবার সংস্কৃতি জুলাই গণ অভ্যুত্থান উত্তর বাংলাদেশে কাম্য ছিল না। এই প্রবণতা চলতে থাকলে যানজট-দূষণে স্থবির ও অবাসযোগ্য হয়ে পড়া ঢাকা আরও নিশ্চল হয়ে পড়বে। এ থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পনাগত টেকসই কৌশল ও পন্থা কাজে লাগিয়ে জনস্বার্থ, বাসযোগ্যতা, জনস্বার্থ ও পরিবেশকে প্রাধান্য দিয়েই ড্যাপের প্রয়োজনীয় পরিমার্জনা করতে হবে।
অনুষ্ঠানে অন্যদের বক্তব্য রাখেন আইপিডির অধ্যাপক আকতার মাহমুদ, পরিকল্পনাবিদ রাকিবুল রনি, স্থপতি আমিনুল ইসলাম ইমন, পরিবেশকর্মী আমিরুল রাজিব ও পরিকল্পনাবিদ সাজিদ ইকবাল প্রমুখ।