বিজয় মাসের আজ চতুর্থ দিন
বিজয় মাসের আজ চতুর্থ দিন। হাজার বছর ধরে স্বাধীনতাহীন বাঙালি জাতি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ অর্জন করেছে এ মাসেই। আর এ অর্জনে দিতে হয়েছে এক সাগর রক্ত আর লাখো মা-বোনের সম্ভ্রম। যতদিন এ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন ডিসেম্বর বিজয়ের মাস হিসেবে উদযাপিত হবে।
৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ডিসেম্বরের মুক্তিযুদ্ধ এক ভিন্ন এক মাত্রা পেতে শুরু করে। বর্ষা, শরৎ আর হেমন্ত পেরিয়ে শুরু হয় শীতের মৌসুম। গ্রামবাংলাজুড়ে শীত নামে। কিন্তু শীত নেই মুক্তিপাগল বাঙালির। হানাদারবাহিনীকে পরাজিত করতে দেহের রক্ত যেন টগবগিয়ে ফুটছে।
একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনে চারদিকে বীর বাঙালির বিজয়, আর পাকহানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর। দেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যুদস্ত হতে থাকে উর্দুভাষী হানাদাররা। ডিসেম্বর মাসের প্রতিটি দিনই শত্রুর পরাজয়ের ক্ষণগণনা চলছিল। এক একটি দিনে রচিত হচ্ছিল বাঙালির বিরত্বগাথার নিত্যনতুন ইতিহাস। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সেসব বীরত্বগাথা ইতিহাস আমাদের নতুন করে বাঁচার আশা জাগায়।
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই দখলদার পাক হানাদারদের পরাজয় অনিবার্য হয়ে ওঠে। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পাকিস্তানিরা সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধও শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের দোসর হয়ে ওঠে। কিন্তু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন অকৃপণ সহযোগিতায় সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। ৪ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রশ্ন তোলে। কিন্তু ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণে সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হয়নি।
একাত্তরে এই দিন সকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। বৈঠকে বসে দেখলেন যৌথ বাহিনী ঠিক ঠিকই এগিয়েছে। প্রথমত: তারা কোথাও শহর দখলের জন্য অগ্রসর হয়নি। দ্বিতীয়ত: কোথাও শত্রু পাকিস্তানি ঘাঁটির সঙ্গে বড় লড়াইয়ে আটকে পড়েনি। তৃতীয়ত: পাকিস্তানি সমরনায়করা তখনো বুঝতে পারেনি ভারতীয় বাহিনী ঠিক কোন দিক দিয়ে ঢাকায় পৌঁছতে চাইছে। বরং তখনো তারা মনে করছে ভারতীয় বাহিনী সীমান্তের মূল পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালাবে।
চতুর্থত: ব্যাপক বিমান এবং স্থল আক্রমণে শত্রুপক্ষকে একেবারে বিহ্বল করে দেওয়া গিয়েছিল। পঞ্চমত: পাকিস্তানি বিমান বাহিনীকে অনেকটা ঘায়েল করে ফেলা হয়েছে। তাদের বিমান ঘাঁটিগুলোও বিধ্বস্ত। ষষ্ঠত: পাকিস্তানের প্রধান নৌবন্দরগুলো অর্থাৎ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চালনা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জে জাহাজ বা স্টিমার ভেড়ানোর ব্যবস্থাও অনেকটা বিপর্যস্ত এবং সপ্তমত: বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক এবং বাড়িঘরও মোটেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী তাই যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনেও একই লক্ষ্যে এগিয়ে চলল।
পশ্চিম দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিফৌজের সব কয়টা কলাম সামনে এগিয়ে চলল। কিন্তু কোথাও তারা সোজাসুজি পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলোর দিকে এগুলো না। মূল বাহিনী সর্বদাই ঘাঁটিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল এবং ঘাঁটিতে অপেক্ষমাণ পাকিস্তানি বাহিনী যাতে মনে করে যে, ভারতীয় বাহিনী তাদের দিকেই এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে। সেজন্য প্রতি পাকিস্তানি ঘাঁটিতে অবিরাম গুলিবর্ষণও চলতে থাকল। এ উদ্দেশ্যে প্রতি পাকিস্তানি ঘাঁটির সামনে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর কিছু কিছু সদস্য রেখে যাওয়া হলো।
মূল ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানিরা তার খবরও পেল না। কারণ প্রথমত, তাদের সমর্থনে দেশের জনগণ ছিল না, যারা খবরাখবর দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, তাদের বিমান বাহিনী তখন বিধ্বস্ত। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেতারে খবরাখবরের ব্যবস্থাও ভালো ছিল না। সুতরাং নিজস্ব ব্যবস্থায়ও তারা খবরাখবর পেল না। তাই ভারতীয় বাহিনী যখন সোজাসুজি যশোর, হিলি, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনি প্রভৃতি পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটির দিকে না গিয়ে যে তারা সোজা চলে যাচ্ছে তা তারা কোনোভাবেই বুঝতে পারল না।
বরং ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণের বহর দেখে তখনো তারা মনে করছে ভারতীয় বাহিনী তাদের দিকেই এগোনোর চেষ্টা করছে। সেজন্য তারা তখনো মুল সড়কগুলো আগলে বসে রইল। সীমান্তের কাছাকাছি পাকিস্তানি বাহিনী তখনো অধিষ্ঠিত একমাত্র কুষ্টিয়া ছাড়া। দর্শনা যে মুহূর্তে ৪নং পার্বত্য ডিভিশনের কামানের পাল্লার মধ্যে এসে গেল পাকিস্তানিরা অমনি শহর ছেড়ে আরও পশ্চিমে পালাল। এদিকে ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো বারবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভৃতি এলাকায় সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। ঢাকায় সেদিনও জোর বিমানযুদ্ধ হলো। কিন্তু সেদিনই প্রায় শেষ বিমানযুদ্ধ। অধিকাংশ পাকিস্তানি বাহিনী ঘায়েল হলো। বিমানবন্দরগুলোও প্রচ- ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নানা অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে স্মরণ করছে প্রিয় মাতৃভূমির জন্য আত্মউৎসর্গকারী শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।