ডেঙ্গুর পাশাপাশি নতুন আতঙ্ক জিকা, চিকুনগুনিয়া
২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কম হলেও এতে আক্রান্ত হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর দেশজুড়ে বিভিন্ন রোগে ভুগে মৃতদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যাই বেশি। তবে সম্প্রতি চিকুনগুনিয়া এবং জিকা ভাইরাসের রোগীও পাওয়া যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে কয়েকদিনের ব্যবধানে দেশে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ৬৭ জন এবং জিকায় আক্রান্ত ১১ জনকে পাওয়া গেছে। এদের প্রত্যেকটি রোগেরই বাহক যেহেতু এডিস মশা তাই এই মশা নিধনে জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
সোমবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ডেঙ্গু বিষয়ক সংবাদ সম্মেলনে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর জানান, এ বছর ঢাকা শহরে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী মানুষ বেশি মারা গেছেন। যাদের বেশিরভাগই কর্মক্ষম ব্যক্তি। অন্যদিকে চট্টগ্রামে শিশু ও বয়স্ক মানুষের মৃত্যুহার বেশি।
তিনি বলেন, আমরা মৃত্যুর কারণ জানার জন্য ডেথ রিভিউ শুরু করেছি। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, দেরিতে হাসপাতালে যাওয়ায় মৃত্যু বেশি হয়েছে। রোগীরা একেবারেই শেষ পর্যায়ে হাসপাতালে আসছেন। তখন সঠিকভাবে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। তিনি বলেন, যেকোনো রোগে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও এটা অতি প্রয়োজনীয়। আমরা নিজেদের সহজেই মশার কামড় থেকে রক্ষা করতে পারি।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার কমানোর জন্য কারও জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গণমাধ্যমের পরামর্শ এবং সহযোগিতাও কামনা করেন তিনি। এসময় সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. হালিমুর রশিদ বলেন, ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ, যা মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে হয়ে থাকে। সাধারণত ডেঙ্গু রোগটি শহরাঞ্চলের একটি রোগ, তবে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। সবমিলিয়ে এ বছর এখন পর্যন্ত (১ ডিসেম্বর) ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ৯২ হাজার ৩৫১ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৪৯৪ জন।
বিভাগভিত্তিক ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য উপস্থাপন করে তিনি বলেন, গত বছর (২০২৩ সাল) ঢাকায় ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩২১ জন, এবার এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৫২ হাজার ৯৭৪ জন। ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ৪৪ হাজার ৪৩৫ জনের, এ বছর বিভাগটিতে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ১৪ হাজার ৪৩০ জন। গত বছর খুলনা বিভাগে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল ৩৮ হাজার ৪৯ জনের, আর এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে ৯ হাজার ১২ জনের। বরিশালে গত বছর ৩৪ হাজার ৭২২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও এ বছর হয়েছে ৭ হাজার ৯৫৭ জনের।
ময়মনসিংহে গত বছর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল ১৯ হাজার ৪০৯ জনের। এ বছর ২ হাজার ৭৯৬ জন আক্রান্ত হয়েছে। রাজশাহীতে গত বছর ৮ হাজার ২৬৮ জন এবং এ বছর ৩ হাজার ৪৫২, রংপুরে গত বছর ৫ হাজার ৫৪০ জন এবং এ বছর ১ হাজার ৪৩১ জন, সিলেটে গত বছর ১ হাজার ৪৩৫ জন এবং এ বছর ২৯৯ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুতেও রাজধানী ঢাকা এগিয়ে উল্লেখ করে হালিমুর রশিদ জানান, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে সর্বমোট মৃত্যুর ১ হাজার ১৬৩ জনই ছিলেন ঢাকার বাসিন্দা। তবে এ বছর রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৩৯ জনের। গত বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছিল ১২৪ জনের। এ বছর মৃত্যু হয়েছে ৫০ জনের। গত বছর খুলনা বিভাগে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছিল ২০৬ জনের। এ বছর মারা গেছে ২৭ জন।
এছাড়া বরিশালে গত বছর ১২৫ জন এবং এ বছর ৫৬ জন, ময়মনসিংহে গত বছর ৬০ জন এবং এ বছর ১৩ জন, রাজশাহীতে গত বছর ১৬ জন এবং এ বছর ৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এ বছর সিলেটে ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যু হয়নি। গত বছর সেখানে ১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। রংপুরে গত বছর ১০ জন মারা গিয়েছিল, এ বছর মৃত্যু হয়েছে ২ জনের।
চলতি বছরে এডিস মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়ায় ৬৭ জন এবং জিকায় ১১ জন আক্রান্ত হয়েছেন জানিয়ে এসময় ডা. হালিমুর রশিদ বলেন, চলতি বছরের এখন পর্যন্ত মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়ায় ৬৭ জন এবং জিকা ভাইরাসে ১১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। জিকা ভাইরাসে আক্রান্তের ৯০ শতাংশের কোনো লক্ষণ (সিম্পটম) থাকে না এবং মৃত্যুহার প্রায় শূন্য। গর্ভবতী মায়েরা জিকা আক্রান্ত হলে তার মাথা ছোট হতে পারে। তবে জিকায় মৃত্যুর হার নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলেও উল্লেখ করেন তিনি। চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুহার প্রসঙ্গে বলা হয়, চিকুনগুনিয়ায়ও মৃত্যু হার খুবই কম। আইইডিসিআরে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে গিয়ে এই ভাইরাস শনাক্ত করেছে।
এসব রোগ প্রতিরোধে মশা নিধনের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব যখন ২০ এর ওপর থাকে, তখন ধরে নেওয়া হয় এডিস মশা বাড়বে। এডিস মশার ঘনত্বের পাশাপাশি কোনো জায়গায় যদি ডেঙ্গুরোগী থাকে তাহলে এডিস মশা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। বর্তমানে আমাদের এডিস মশাও আছে আবার রোগীও আছে, দুইটা বিষয় যখন একসঙ্গে থাকে তখন ডেঙ্গু বাড়বে এবং সেটা থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর নভেম্বরে ডেঙ্গুর যে ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে এর আগে বাংলাদেশে তা কখনই হয়নি। ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তবে এর জন্য মশার প্রজনন যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত উড়ন্ত মশাগুলোকে মারার ব্যবস্থা করতে হবে এবং কেউ যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, তাকে পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু নিশ্চিত হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।