আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিটি
বাংলাদেশের আদালত ভারতের বিতর্কিত আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিটি বাতিল না করলে সরকার এই চুক্তির আওতায় বিদ্যুতের দাম অনেকটা কমানোর উদ্যোগ নেবে। রবিবার রয়টার্সকে এ কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আদালত আদানির সঙ্গে করা ২৫ বছর মেয়াদের চুক্তিটি তদন্ত করে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।
আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ২৬৫ মিলিয়ন ডলার ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। যদিও এই অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। তবে ঘুষ ও জালিয়াতির অভিযোগ আসার পর ইতোমধ্যে ভারতের একটি রাজ্য আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি পর্যালোচনা করছে এবং ফ্রান্সের টোটাল এনার্জিস বিনিয়োগ স্থগিত করেছে।
বাংলাদেশে এক আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত সপ্তাহে আদানির ২ বিলিয়ন ডলারের কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প চুক্তি তদন্তে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই তদন্তের প্রতিবেদন ফেব্রুয়ারিতে আদালতে উপস্থাপন করা হবে। এর পরই এ বিষয়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন।
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ২০১৭ সালে আদানি গ্রুপের সঙ্গে এই চুক্তি সই হয়েছিল। ঝাড়খ- রাজ্যে অবস্থিত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এই কয়লাভিত্তিক প্রকল্প থেকে গত বছর বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ পূরণ করছে এ কেন্দ্র।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘চুক্তিতে কোনো অসঙ্গতি থাকলে তা নিয়ে পুনরায় আলোচনা করা হবে। দুর্নীতি বা ঘুষের মতো অনিয়ম পাওয়া গেলেই কেবল চুক্তি বাতিল বিবেচনা করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘দুটি কাজই হবে আদালতের নির্দেশে করা তদন্তের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে।’ তিনি আরও বলেন, চুক্তির কিছু বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যেই আদানি গ্রুপকে অবহিত করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ভারতের কর অব্যাহতির সুবিধা বাংলাদেশ পাচ্ছে নাÑ যা চুক্তিটি নিয়ে পুনরায় আলোচনার ভিত্তি হতে পারে।
এ বিষয়ে রয়টার্সের পক্ষ থেকে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলেও আদানি তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয়নি।
আদানি পাওয়ার লিমিটেড তাদের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, ঝাড়খ- রাজ্যের এই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন, নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এবং গ্রাহকের ‘গড় খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে’ আনবে।
ফাওজুল কবির বলেছেন, আদানির বিরুদ্ধে মার্কিন কর্তৃপক্ষ দুর্নীতির যে অভিযোগ এনেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিতে তার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম।
এদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি পৃথক কমিটি গঠন করে আদানি চুক্তিসহ আরও ছয়টি বিদ্যুৎ চুক্তির বিষয়ে তদন্ত করছে। আন্তর্জাতিক দরকষাকষি ও সালিশি ক্ষেত্রে এই তদন্ত গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে বলে এক বিবৃতিতে সরকার জানিয়েছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম নিয়েছে ১৪.০২ টাকা। ভারতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের মধ্যে আদানিই বিদ্যুতের দাম রেখেছে সবচেয়ে বেশি। অন্য উৎপাদনকারীরা গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম রাখে ৮.৭৭ টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে আদানির বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ১২ টাকায় নেমে এলেও তা ভারতের অন্যান্য বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের তুলনায় যথাক্রমে ২৭ শতাংশ ও ৬৩ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ৮.৯৫ টাকা। এর ফলে ভর্তুকি বাবদ সরকারের বছরে ব্যয় ৩২০ বিলিয়ন টাকায় দাঁড়ায় বলে জানান ফাওজুল কবির।
তিনি বলেন, ‘দাম বেশি দাম হওয়ায় সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আমরা চাই শুধু আদানির ক্ষেত্রে নয়, বিদ্যুতের দাম সামগ্রিকভাবেই গড় খুচরা মূল্যের নিচে নেমে আসুক।’ তবে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় অব্যাহত অব্যাহত থাকবে বলে জানান ফাওজুল কবির। বিল পরিশোধে বিলম্ব হওয়ায় আদানি সম্প্রতি বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছিল।
ফাওজুল কবির আরও বলেন, বাংলাদেশের নিজস্ব চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট স্থানীয় সক্ষমতা রয়েছে। যদিও গ্যাস সংকট বা অন্যান্য সমস্যায় কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে রয়েছে অথবা সক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। তিনি বলেন, ‘আদানি সরবরাহ কমিয়ে অর্ধেক করে দেওয়ার পরও কোনো সমস্যা হয়নি। কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী যেন আমাদের ব্ল্যাকমেইল করতে না পারে, সেই সুযোগ আমরা দেব না।’