বাগেরহাটের ব্যারাকপুরে জলাবদ্ধ পতিত জমিতে গোলপাতার চাষ হচ্ছে
বাগেরহাটের সদর উপজেলার ব্যারাকপুর এলাকার কালিপদ দাস তার বাড়ি সংলগ্ন নিচু জলাবদ্ধ মাত্র ১০ কাঠা জমিতে গত প্রায় ২০ বছর ধরে গোলপাতার চাষ করছেন। প্রতিবছর গোলপাতা বিক্রি করে তিনি ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকার উপার্জন করেন। বর্ষা মৌসুমে তার জমিতে পানি জমে থাকে। পাশের খাল দিয়েও মাঝেমধ্যে নদীর লবণ পানিও ঢুকে থাকে। এতে তার গোলপাতার কোনো ক্ষতি হয় না।
কালিপদের ভাষায়, ‘প্রতিবছর ডিসেম্বর-জানুয়ারির দিকে ভুটিয়ামারী খাল দিয়ে লবণ পানি ঢোকার আগে জমিতে কানায় কানায় খালের পানি ঢুকিয়ে জমা করেন। পরে তা সারাবছরই গোলগাছের উপযোগী থাকে।’ ফলে তার চাষের কোনো ক্ষতি হয় না।
তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, গোলপাতা শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে মাটিতে চাষ দিয়ে শুকনা ফল রোপণ করতে হয়। এটি এক বছরের মধ্যে কর্তন উপযোগী হয়ে থাকে। এ চাষে তেমন কোনো পরিচর্যা করতে হয় না। শুধুমাত্র আবর্জনা পরিষ্কার ও গরু-ছাগলের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলেই চলে। এ চাষে খরচ অত্যন্ত কম এবং লাভ বেশি।
অনুরূপভাবে একই এলাকার কালাম, আবুল হোসেন, রামপালের সজল দাস, হেমায়েত আলী, মোংলার চিলা ইউনিয়নের হুমায়ুন কবির, শাহজাহান সরদারসহ অনেকেই স্বল্প পরিসরে গোলচাষ করে সফলতা পেয়েছেন। তাদের মতে, সুন্দরবন সংলগ্ন নদী ও খালকে অবমুক্ত রেখে নদী-খালে মাত্রাতিরিক্ত লবণ আসার আগেই জোয়ার-ভাটার সময়ে পানি ধরে রেখে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার লক্ষাধিক হেক্টর জমিতে গোল চাষ করা সম্ভব। সুষ্ঠুভাবে এই পানি ব্যবস্থাপনা ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এলাকার শ্রমজীবী ও কৃষকদের সহায়তা করলে গোলপাতা আবাদ একটি লাভজনক চাষ হতে পারে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় গোলপাতার চাষ বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে প্রতিবছর সুন্দরবন থেকে অবৈধভাবে কয়েক লাখ কাউন গোলপাতা কাটা বন্ধ হবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। ফলে সুন্দরবনের ওপর চাপ কমবে।
সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষের বিকল্প জীবিকায়ন নিয়ে কাজ করা একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছ থেকে জানা গেছে, সুন্দরবনের গোলপাতা কাটা ও বিক্রির ওপর সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষ নির্ভরশীল। বাগেরহাটের মোংলা, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা ও রামপাল, খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, দেবহাটা ও কালীগঞ্জ, বরগুনার পাথরঘাটা এবং পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ও জিয়ানগর উপজেলাসহ সংলগ্ন এলাকার শ্রমজীবী মানুষ বছরের প্রায় ৩ মাস সুন্দরবনের গোলপাতা সংগ্রহ ও বিক্রি করেন। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার আবাদযোগ্য জমিগুলো অধিক হারে লবণাক্ত হওয়ায় সেখানে তেমন চাষাবাদ সম্ভব হয় না। কিছু কিছু এলাকায় চিংড়ি ঘেরের চাষ হলেও তার অধিকাংশ এখন প্রভাবশালীদের কব্জায়। ক্ষুদ্র চিংড়ি চাষিরা মূলধনসহ নানা কারণে প্রায়শই লোকসানের মুখে পড়েন।
এ কারণে সাধারণ খেটে খাওয়া পরিবারগুলো বেঁচে থাকার জন্য সুন্দরবনের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। কখনো কখনো বনবিভাগের কাছ থেকে পাসপারমিট নিয়ে আবার কখনো অবৈধভাবে সুন্দরবনে তারা প্রবেশ করেন। ফলে সুন্দরবনের গোলপাতাসহ বনজ সম্পদের ওপর চাপ বাড়ে। বনবিভাগসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদারকির পরেও সুন্দরবন থেকে কাঠ-গোলপাতা আহরণ, মাছ শিকার কমছে না।
মোংলার চাঁদপাই এলাকার আব্দুল খালেক, জলিল মোড়ল, আ. গনি হাওলাদার, শরণখোলার তেরাবেকা লোকার বেল্লাল হোসেন, নজরুল ব্যাপারী, বগীর সিরাজুল ইসলাম শরিফ ও জামাল শরিফ জানান, এলাকায় যখন কাজ থাকে না, তখন জীবন বাঁচানোর তাগিদে নিরুপায় হয়ে সুন্দরবনে ঢুকতে হয়। সুন্দরবনের গোলপাতাসহ মাছ, কাঠ, মধু ইত্যাদি সংগ্রহ ও বিক্রি করে তাদের এলাকার অধিকাংশ শ্রমজীবী ও দরিদ্র মানুষ বেঁচে আছে। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না হলে এটি বন্ধ হবে না বলে তারা উল্লেখ করেন।
বনবিভাগ সূত্র জানায়, প্রতিবছর সুন্দরবন থেকে গোলপাতা কাটার জন্য প্রায় এক হাজার জেলে-বাওয়ালী নৌকা, ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও ট্রলারকে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর বাইরেও সংলগ্ন এলাকার শ্রমজীবী মানুষ অবৈধভাবে সুন্দরবনে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বনবিভাগের হাতে ধরা পড়ে। সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলার অনেক মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভর করেন। যে কারণে সুন্দরবনের গোলপাতাসহ বিভিন্ন প্রকার বনজ সম্পদের সুরক্ষা সব সময় সম্ভব হয় না। বিশাল সুন্দরবনে বনরক্ষীর সংখ্যা তুলনায় খুবই কম। ফলে সংলগ্ন এলাকার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান হলে সুন্দরবনের ওপর চাপ কমবে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মো. নূরুল করিম জানান, বনসংলগ্ন এলাকার শ্রমজীবী অধিকাংশ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে তারা বৈধ-অবৈধভাবে মাছ, কাঠ, মধু, গোলপাতাসহ সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ করে থাকেন। আবার সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলাগুলোর কোনো কোনো স্থানে অনেক সময় জমি পতিত থাকে। কাজেই সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারলে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পবে।