ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর ধান্দা

মাহবুব নাহিদ (রাজনৈতিক বিশ্লেষক)

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ২৯ নভেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২২:৪৮, ২৯ নভেম্বর ২০২৪

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর ধান্দা

ঘর পোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, তেমনি আমাদের দেশে এখন যা কিছু ঘটছে, তা দেখে মনে হয় যেন পরাজিত শক্তি আবার ফিরে আসছে। ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ভারত থেকে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। এর মধ্যে তার বেশ কিছু অডিও কল ফাঁস হয়েছে, যেখানে তিনি চট করে ঢুকে পড়তে চাওয়ার মতো কথাবার্তা বলেছেন। মূলত এসবের মূলে একটি কথা, আওয়ামী লীগ সবকিছুতেই নিজেদের ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

 


আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল, তারা সবকিছুতেই বিএনপি-জামায়াতের ছায়া খুঁজে পেত। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এখন তাদেরই ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সবকিছুর মধ্যেই ঢুকতে হচ্ছে। রিকশাওয়ালাদের আন্দোলনে, আনসারদের আন্দোলনে, এমনকি সব আন্দোলনের মধ্যে তাদের একটাই লক্ষ্য—কোনোভাবে সরকারকে বিপদে ফেলা। ঘটনার চক্রবাক, একে একে যত আন্দোলন হচ্ছে, সেসবের মাঝেই যেন ফ্যাসিবাদের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে।

রিকশাওয়ালাদের আন্দোলন ছাড়িয়ে নতুন একটি আন্দোলন শুরু হয়, যা পরে হিন্দুদের আন্দোলনে রূপ নেয়। সনাতনী জাগরণী জোটের আন্দোলনের সঙ্গে অনেক আওয়ামী লীগের মুসলিম সদস্যদের যোগদান লক্ষ্য করা যায়।


হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ভারতীয় মিডিয়া বারবার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের হিন্দুদের পরিস্থিতি খারাপ দেখাতে। আর ভারতে মুসলমানরা নরেন্দ্র মোদীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ—এমন বিষয়ও ভারতীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের দেশে ঘটেছে কয়েকটি হামলা, যা মূলত রাজনৈতিক। হামলাগুলি রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িতে হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া সেটা হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হিসেবে প্রচার করছে। এক সাংবাদিক নামক "মলম বিক্রেতা" তীব্র শোরগোল সৃষ্টি করছে, আর এসব ঘটনার মাধ্যমে হিন্দুদের আন্দোলনকে অন্য খাতে নিতে চেষ্টা করছে সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বহ্মচারী। মজার বিষয় হলো, চিন্ময় নিজেই ইসকন থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বহিষ্কৃত হয়েছেন।

ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (ইসকন) বিশ্বজুড়ে আধ্যাত্মিক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও, বাংলাদেশের ইসকন শাখা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। সম্প্রতি চট্টগ্রামে একটি মিছিলে জাতীয় পতাকার অবমাননা করা এবং তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও দায়ের করা হয়েছে। ইসকন একটি উগ্রবাদী সংগঠন হিসেবে পরিচিত, এবং বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নিবন্ধন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ এখন ইসকন নিষিদ্ধ করতে চায়, ইসকন নিষিদ্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি।


চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বর্তমানে "বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণী জোট" নামক একটি সংগঠনের মুখপাত্র হিসেবে সক্রিয়। তবে প্রশ্ন উঠেছে, কেন ৫ আগস্টের পর এই সংগঠন এত তৎপর হয়ে উঠেছে? চিন্ময় কৃষ্ণ এর আগে হাসিনার পক্ষে নানা বক্তব্য দিয়েছেন এবং এখন তার কর্মকাণ্ডে ভারতীয় এজেন্ডার বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কিছুদিন আগে স্বর্ণা দাস নামে এক নারী বিএসএফের গুলিতে নিহত হন, এ ব্যাপারে চিন্ময় তার বক্তব্যে বলেন, স্বর্ণা নাকি মুসলমানদের অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে বিএসএফের গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। অথচ, তার যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য এত মায়া থাকত, তাহলে কেন তিনি আহত বা নিহত হিন্দু ছাত্রদের বাড়িতে গিয়ে সমবেদনা জানাননি?


যারা দেশের বিরুদ্ধে, জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা উচিত। চিন্ময় দাসের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে। তিনি যদি নির্দোষ হন, তবে তাকে আদালতে গিয়ে মামলার মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আদালতের বাইরে একজন আইনজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। এটি স্পষ্ট যে, কিছু গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির চেষ্টা করছে, এবং তাদের এ কাজের নির্দেশনার উৎস ভারতে।
চিন্ময় দাসের আটকের পর ইসকন বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম থেকে ভারতের হস্তক্ষেপ চেয়ে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। এমনকি ভারতীয় মিডিয়া আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের মৃত্যু নিয়ে ভুল তথ্য প্রচার করছে। বাংলাদেশের সরকারও এখন সতর্ক হয়েছে এবং জানিয়েছে, তারা ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক চায় সমতা ও সততার ভিত্তিতে।
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যার পর দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে, তবে দেশের মানুষ ধৈর্য দেখিয়েছে। এই সময় বাংলাদেশে মুসলমানরা যে সহিষ্ণুতা ও পরিপক্বতা দেখিয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমাদের দেশে ইসলাম মানে শান্তি, সহনশীলতা এবং মানবিকতার শিক্ষা। সম্প্রতি দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে মুসলমানরা যেভাবে মন্দির পাহারা দিয়েছে, তা আমাদের আশা জাগিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, আমরা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সব ধর্মের মানুষ একে অপরকে সম্মান করি এবং আমাদের মাঝে কোনো বিভেদ নেই।


একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইসকন কখনোই পুরো হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে না। আমাদের দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে, ঠিক যেমন মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে। বাংলাদেশে, আমরা সবাই ভাই-বোন, এবং ধর্মীয় বিভেদ কখনোই আমাদের মধ্যে স্থান পায়নি। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান—সব ধর্মের মানুষ এখানে একে অপরকে ভালোবাসে, সম্মান করে এবং একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের দেশে কোনও ধর্মীয় বিবাদ নেই, বরং ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বই আমাদের শক্তি। আমরা জানি, মানবতার মধ্যে সবার আগে ভালোবাসা, শান্তি এবং একতা, আর তাই আমরা চাই না কোনো ঘটনার মাধ্যমে আমাদের শান্তিপূর্ণ সমাজে অশান্তি তৈরি হোক। এই ঐক্যই আমাদের সঠিক পথ দেখায় এবং আমাদের শক্তি প্রদান করে।
ভারত সবসময় আমাদের শত্রুর চোখে দেখেছে। পানির হিস্যা থেকে শুরু করে, সীমান্তে হত্যা এবং নানা ধরনের অমীমাংসিত বিষয়, ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কখনোই সঠিক মূল্যায়ন পাইনি। সীমান্তে গুলি চলছেই, আমাদের মানুষ নিহত হচ্ছে, কিন্তু ভারত আমাদের কোনো সমঝোতা দেয় না। যদিও আমরা পাশের দেশটির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাওয়ার কথা বলছি, তবুও আমাদের দাবি স্পষ্ট—এই সম্পর্কের ভিত্তি হতে হবে সমতা এবং সহযোগিতার। এতে দুই পক্ষই লাভবান হবে, কেউ একপক্ষীয় সুবিধা পাবে না। সম্পর্কের ক্ষেত্রে একতরফা সুবিধা গ্রহণ আর অসমতাই আমাদের মূল সমস্যা।


আমাদের ঐক্য রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। যারা বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইবে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর অবস্থান নিতে হবে। আমাদের সমাজে যখন কেউ বা কিছু আমাদের ঐক্যকে নষ্ট করার চেষ্টা করবে, তখন আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা জানি, কোনো শক্তি আমাদের ঐক্যকে ভাঙতে পারবে না, যদি আমরা একসাথে থাকি। আমাদের সমাজের মূল শক্তি হচ্ছে একতা, এবং এটাই আমাদের শক্তির উৎস। তাই, যতই চক্রান্ত হোক, আমরা অবশ্যই নিশ্চিত করবো যে আমাদের সমাজে বিভেদ এবং অশান্তি কখনোই স্থান পাবে না।

লেখক

মাহবুব নাহিদ 
রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ফুয়াদ

×