ইসকন
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) ইস্যুতে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে হাইকোর্টকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী। এ সময় উচ্চ আদালত বলেছেন, ইসকন নিষিদ্ধ হবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ নিয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ করা উচিত হবে না। শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেন, আমরা মনে করি দেশের মানুষ অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান হলেও মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও পার্বত্য এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রত্যেকের সঙ্গে। প্রত্যেকে আমাদের বিশ্বাস এই সম্পর্ক কোনোদিন ভাঙবে না।’ বৃহস্পতিবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। হাইকোর্ট আশা প্রকাশ করে বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং জনগণের জানমাল রক্ষায় সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।
এর আগে, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন হাইকোর্ট বেঞ্চকে জানান যে, সরকার এটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এবং প্রধান একটি ইস্যু ধরে অ্যাকশন নিয়েছে। পুলিশ তিনটি মামলা দায়ের করেছে। তিনটি মামলার একটিতে ১৩ জন, আরেকটিতে ১৪ জন ও অপরটিতে ৪৯ জনের নামে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ছয়জনকে শনাক্ত করা গেছে, যারা এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। আর যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে নিশ্চয়ই আরও তথ্য বের হয়ে আসবে।
আসাদ উদ্দিন আরও বলেন, পুলিশসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। শুধু চট্টগ্রামেই নয়, যেসব স্থানের কথা এসেছে, যেসব জায়গায় এ ধরনের তৎপরতা দেখা গেছে, প্রত্যেক জায়গাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। সরকার এটাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে অ্যাড্রেস করেছে।
এ সময় আদালত বলেন, ‘আমরা শুনে আশ্বস্ত হলাম, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছেন। ঘুরেফিরে একটাই কথা, দেশের জনগণের জানমাল, কারও যেন কোনো ক্ষতি না হয়, এটা সবারই চিন্তা। আপনারা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছেন শুনে আদালত আশ্বস্ত হয়েছে।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক বলেন, তিনটি মামলা হয়েছে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সম্ভাব্য যত ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সবধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে যেকোনো আদেশ দেওয়া সমীচীন হবে না। এ সময় আদালত বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। তাই এখন কোনো প্রয়োজন (আদেশ) তো নেই। একপর্যায়ে আদালত আরও বলেন, আমরা মনে করি দেশের মানুষ অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান হলেও মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও পার্বত্য এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে। আমাদের বিশ্বাস এই সম্পর্ক কোনোদিন ভাঙবে না। আমাদের একজনের প্রতি একজনের যে অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এটা কোনোদিনও নষ্ট হবে না। আমাদের বাংলাদেশ যেই ধরনের, আমরা নাগরিক সেই ধরনের।
ইসকন নিষিদ্ধ চাওয়া আইনজীবী মো. মনির উদ্দিন বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে ইসকন। এর আগে গত বুধবার ইসকন নিষিদ্ধ চেয়ে হাইকোর্টে মৌখিক আবেদন করেন আইনজীবী মো. মনির উদ্দিন। যার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষের মতামত জানতে জরুরি ভিত্তিতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে আদালতে ডেকে পাঠানো হয়। পরে ইসকন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দাখিল করতে বলেন হাইকোর্ট। গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানা এলাকায় অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম আলিফ (৩৫) নামে এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় তিনি খুন হন। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে আদালতের অদূরে রঙ্গম কমিউনিটি সেন্টারের সামনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফ (৩৫) সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি)। তিনি লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি গ্রামের জামাল উদ্দিনের ছেলে এবং চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য।
ইসকন নিষিদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট বারের দাবি ॥ চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহতের ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। একইসঙ্গে ইসকনকে নিষিদ্ধ করতে জোরালো দাবি জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির শহীদ শফিউর রহমান মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানানো হয়।
লিখিত বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্ট বারের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মিলন বলেন, চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে উগ্র সংগঠন ইসকন সদস্যদের হামলায় গত ২৬ নভেম্বর আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে হত্যার ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সাইফুল ইসলাম আলিফ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য। কোনো আইনজীবী অনাকাক্সিক্ষতভাবে মারা গেলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।
আলিফকে হত্যা করার এই ঘটনা সারা বাংলাদেশের আইনজীবীসহ ১৮ কোটি মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করেছে। তিনি বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকার পতনের পর ফ্যাসিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসীরা দেশী-বিদেশী দোসরদের নিয়ে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সন্ত্রাসী সংগঠন ইসকন সদস্যরা সাইফুল ইসলাম আলিফকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। আইনজীবী আলিফের নৃশংস হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানান সুপ্রিম কোর্ট বার।
আইনজীবী সুরক্ষা অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও ইসকন নিষিদ্ধের দাবি ॥ চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যার ঘটনায় ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ আইনজীবী অধিকার পরিষদ। বৃহস্পতিবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট বার প্রধান ফটকে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
মানববন্ধনে অবিলম্বে আইনজীবী সুরক্ষা অধ্যাদেশ প্রণয়ন জারিরও দাবি করা হয়। বাংলাদেশ আইনজীবী অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট নুরে এরশাদ সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে ও যুগ্ম আহ্বায়ক মো. খালিদ হোসেনের সঞ্চালনে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন ব্যারিস্টার মহিউদ্দিন ইউসুফ, অ্যাডভোকেট শেখ শওকত হোসেন, হাবিবুর রহমান, সাজেদুল ইসলাম রুবেল, মমিনুল ইসলাম, মেহেদী হাসান প্রমুখ।
মানববন্ধনে অ্যাডভোকেট নুরে এরশাদ সিদ্দিকী বলেন, নতুন বাংলাদেশে আইনজীবীরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে পারে না। সরকারি আইন কর্মকর্তাগণ হত্যার শিকার হলে ন্যায়বিচার বিঘিœত হবে। আইন আদালতের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা কমে যাবে। তাই অবিলম্বে আইনজীবী সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ইসকন একটি আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন। বিশ্বের নানা দেশে উগ্রবাদী ও উসকানিমূলক কর্মকা-ের কারণে ইসকনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সম্প্রতি চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে ইসকনকে নিষিদ্ধ করতে হবে। মানববন্ধন শেষে আইনজীবী অধিকার পরিষদ সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে একটি বিক্ষোভ মিছিল করে।