ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বাতিলের সিদ্ধান্ত হলেও অধ্যাদেশ জারির জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি

সাইবার নিরাপত্তা আইনের মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন মানুষ

তপন বিশ্বাস

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ২৮ নভেম্বর ২০২৪

সাইবার নিরাপত্তা আইনের মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন মানুষ

সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত

সরকার বহুল আলোচিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলেও অধ্যাদেশ জারি না করায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন এই আইনে মামলার শিকার সাধারণ মানুষ। বিগত ৭ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদে আইনটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তা অধ্যাদেশ জারির জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি। এই সুযোগে এই আইনে মামলা হওয়া সাধারণ জনগণকে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, উপদেষ্টা পরিষদে আইনটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এ পর্যন্ত তা লেজিসলেটিভ বিভাগে এসে পৌঁছায়নি। আমাদের কাছে এলে এবং সরকারের অনুমোদন পেলে দ্রুত তা গেজেট আকারে প্রকাশ করতে পারব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই আইনে হওয়া মামলার এক ভুক্তভোগী জনকণ্ঠকে বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হওয়ায় ইতোপূর্বে প্রাথমিক তদন্তে তা বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু আইনটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর এটি আবার নতুন করে তদন্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যেখানে আগে তদন্ত করে তা বাতিল করা হয়, সেখানে নতুন করে তদন্ত করা মানে হয়রানি করা। কারণ এখন আইনটিই থাকছে না। যেখানে বলা হয়েছে, আইনটি বাতিলের সঙ্গে পুরনো মামলাগুলোও বাতিল হয়ে যাবে।
সূত্র জানায়, বিগত ৭ নভেম্বর সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করার জন্য উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর পর চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া হবে। পরে এটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাতিল করা হবে। আইনটি বাতিল হলে বিদ্যমান মামলাগুলোর কী হবে তা অধ্যাদেশে উল্লেখ থাকবে।
অপর এক সূত্র জানায়, আইন বাতিল হলেও বিদ্যমান মামলা বাতিল হয় না। এই মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনটি বর্তমান বলে পরিগণিত হয়। অপরাধ ঘটে গেলে আইন বাতিল হলেও মামলা চলমান থাকে।
সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে এই আইন ব্যবহার হয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য আইনটি বাতিল বা সংশোধনের বিষয়ে কিছুদিন ধরেই অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল। উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্তের কিছুদিন আগে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন এক সপ্তাহের মধ্যে বাতিল হবে এবং এই আইনের অধীনে যত মামলা হয়েছে, সব মামলাও প্রত্যাহার হবে। 
তারও আগে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছিলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা উচিত। সেদিকেই যাবে সরকার। এটা বাতিল হবে। পরবর্তী সময়ে যখন নতুন আইন হবে, এটার বেসিক অ্যাপ্রোচ থাকবে সাইবার সুরক্ষা দেওয়া, বিশেষ করে নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়া।
দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। আইনটি পাশ হওয়ার পরও প্রতিবাদ চলতে থাকে। সেই প্রতিবাদ সামাল দিতে ২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম বদল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়। অনেকটা পুরনো আইনই নতুন নামে করা হয়। এটি নিয়েও ছিল অংশীজনদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ।

আইনটি প্রসঙ্গে গত ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিকদের এক কর্মশালায় হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেছিলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনের পাঁচটি ধারা সাংবাদিকতাকে মারাত্মক বিপদে ফেলতে পারে। এই ধারাগুলো হলো ২২, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৮। এ ছাড়া আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। এ ধরনের নিবর্তনমূলক ধারা স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা ও হুমকি।
আইনটি নিয়ে গত ৩০ এপ্রিল এক ওয়েবিনারে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে প্রধান গবেষক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান। তার গবেষণায় বলা হয়, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক হাজার ৪৩৬টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব মামলায় কমপক্ষে চার হাজার ৫২০ জনকে আসামি করা হয়। সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। আর অভিযোগকারীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা শীর্ষে।
সবচেয়ে বেশি মামলা করা হয়েছে ২০২১ সালে। মামলার শিকার ৪৫১ জনের মধ্যে ২০৯ জন সাংবাদিক জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত এবং ১৯৭ জন স্থানীয় সাংবাদিক। এর মধ্যে সংবাদ প্রকাশের কারণে ২৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২০২০ সাল থেকে ৪৯৫ জন রাজনীতিবিদ এবং ২৮ জন অপ্রাপ্তবয়স্কের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
তাদের মধ্যে ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের আগে অনেক রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ফেসবুক পোস্টের কারণে ৯০৮টি মামলায় দুই হাজার ৩২৮ জনকে আসামি করা হয়।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হলেও সাইবার নিরাপত্তা আইনে একাধিক মামলা করা হয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর অন্তর্র্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং সেনাপ্রধানকে উদ্দেশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর থানার হারিয়াছড়ি গ্রামের মোকতার হোসেনের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে একই গ্রামের মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন মামলা করেন।
সাইবার ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামের বিচারক জহিরুল হকের আদালতে মামলাটি করা হয়। এতে তার বিরুদ্ধে পবিত্র কুরআন ও ধর্ম অবমাননার অভিযোগও আনা হয়। মামলার আবেদন গ্রহণ করে আদালত অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) ২৭ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমার নির্দেশ দেন।
এ প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার এবং আইসিটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনে এখনো যে মামলাগুলো হচ্ছে, সেগুলোয় কোনো পদক্ষেপ বা কাউকে গ্রেপ্তার না করতে আইন মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। আমরা আগেই বলেছি, নিবর্তনমূলক যে আইনগুলো আছে, যেগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা দেবে, সেগুলো আমরা বাতিল অথবা সংশোধন করব।

×