বদিউল আলম
অতীতের অন্যায় ও বৈষম্য দূর করার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, অতীতে যত অন্যায়, বৈষ্যম করা হয়েছে তা দূর করতে আমাদের জন্য অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এমন একটা দেশ গড়তে চাই, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে। যেই চেতনা থেকে আন্দোলন হয়েছে, সেই চেতনার ভিত্তিতেই আমরা পরিচালিত হতে চাই।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, দলিত, প্রতিবন্ধীসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এসব কথা বলেন। সংসদ ভবনের ক্যাবিনেট কক্ষে বুধবার এ মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষ সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ জানান, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদ থাকবে না এমন সুপারিশ তারা করবেন।
কমিশনের চেয়ারম্যান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রোটেশন পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকারে নারীদের জন্য ভোট হতে পারে। এতে পর্যায়ক্রমে নারীরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারবেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যেমন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে ভোট হয়, বাস্তবে সেখানে নারীর প্রতিনিধিত্ব অনেক বেশি হয়। কোনো কোনো জায়গায় পুরুষের চেয়েও বেশি হয়। সুশাসন নিশ্চিত হলে আদিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, আমাদের সুপারিশ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে একটা কথা নিশ্চিত। আদিবাসী, দলিত বা পিছিয়ে পড়া কোনো গোষ্ঠী কোনো রকম যেন বৈষ্যমের শিকার না হয়। ভোটাধিকার থেকে শুরু করে আইনি অধিকার এগুলো যেন প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের যেসব অসঙ্গতি আছে, যা আমরা চিহ্নিত করেছি যেমন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা, উচ্চকক্ষ কীভাবে নির্বাচিত হবে, নারীর জন্য সংরক্ষণ পদ্ধতি, ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ যা অতীতের সংলাপে জোরালোভাবে এসেছে; আমরা এগুলো সততার সঙ্গে নোট নিয়েছি। একটা ধারণা তথ্যভিত্তিক থাকা উচিত। আদিবাসী, সমতল এবং পার্বত্য এলাকায় কত, দলিতদের কত, বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর ব্যাপারে আমরা সুস্পষ্ট ধারণা পেতে চাই।
বদিউল আলম জানান, দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন নয়- এ বিষয়টা জোরালোভাবে এসেছে। রাষ্ট্রপতির নির্বাচন দলভিত্তিক নয়, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন সরাসরি আসবে কি-না, সে প্রস্তাবও এসেছে। ভোটার তালিকা নিয়ে আদিবাসী সম্প্রদায় ও অন্য বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সমস্যা আছে। আমার পরিবারের সদস্যদের নামেও ভুল আছে। এই ব্যাপারে আমরা সুপারিশ করব।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারিত রাখার জন্য একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর দাবি আছে। তবে এটা কোনো অযোগ্যতা হতে পারে না। আমরা চারপাশে যদি দেখি যারা দুর্নীতিগ্রস্ত তারা কি অশিক্ষিত? সবাই শিক্ষিত।
ইসি সংস্কার কমিটির সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা যদি সুপারিশ ঠিক মত দিতে পারি, আর সরকার যদি সেটা গ্রহণ করে, তাহলে স্থানীয় সরকারে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে পারে। উপজেলাতে কোনো ওয়ার্ড নেই। আমরা চিন্তা করছি, এখানেও ওয়ার্ড হবে। এক মহিলা, দুজন পুরুষের সাধারণ আসন থাকবে। স্থানীয় সরকারের নারীদের সরাসরি নির্বাচন করতে বাধা নাই। তারা পারে না বলেই সংরক্ষিত করা হয়। এখন কোনো ইউনিয়নের ১৩টি ওয়ার্ডেই যদি নারী প্রার্থী আসে, কেউ বাধা দিতে পারবে না।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সংস্কার কমিটির প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমাদের সুপারিশ এ রকম হচ্ছে, উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদ থাকছে না। প্রত্যেকটি উপজেলায় ওয়ার্ড হবে। একটা উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন থাকলে ৩০টি আসন হবে। ৩০ জন নির্বাচিত হয়ে একজন চেয়ারম্যান করবেন, ভাইস চেয়ারম্যান করবেন। সরাসরি এটা হবে না। জেলা পরিষদেরও কিন্তু ওয়ার্ড থাকবে আরও বেশি। তখন কিন্তু দাঁড়ানো ও নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ বাড়বে। তবে আদিবাসীদের জন্য কতটুকু বাড়বে তা দেখার বিষয়। না বাড়লে তাদের স্থায়ী কমিটিতে নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, গত তিন নির্বাচনে যে ভয়াবহতা হয়েছে সেটা কি সামনেও হবে! এজন্য রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হতে হবে আদিবাসীদের মধ্যে। ছাত্র-জনতার মুভমেন্ট হয়েছে, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার দরকার আছে। আমি আদিবাসী থাকব। কারও সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকব না। এই চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসব।
ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও সংস্কার কমিটির সদস্য জেসমিন টুলী বলেন, গত তিনটি নির্বাচনে একেবারে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এর আগে কিন্তু এমনটি হয়নি। এখন কোনো প্রার্থী জয়ী হলেও সহিংসতা করে, আর না হলেও করে।
আদিবাসী প্রতিনিধি সন্ধ্যা মালো বলেন, আদিবাসী বললে সমতল আর পাহাড়ি একদিকে হয়ে যায়। আমি মনে করি যদি পিছিয়ে থাকা থেকে শুরু করা যায় তাহলে ভালো হবে। সবাইকে সামনে আনা যাবে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের নির্বাহী কমিটির সদস্য রিপন চন্দ্র বানাই বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থায় অবশ্যই আদিবাসীদের প্রতিনিধি নিশ্চিত করতে হবে। এটি সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও। সংসদে সংরক্ষিত ৫০টি আসন আছে। এটি শুধু দল নয়। মনোনয়ন দেবে না এখানে। পিছিয়ে পড়া, আদিবাসীসহ যাদের প্রতিনিধি কখনও সংসদে প্রতিনিধি আসেনি তাদের মধ্যে থেকে বাছাই করা। নারী, আদিবাসী, দলিত, চা শ্রমিক, কৃষকসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকেও প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিমল চন্দ্র রাজোয়াড় বলেন, নির্বাচনে অভিযোগ দিলে নির্বাচন শেষ হলেও সমাধান হয় না। তাই অভিযোগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত করে প্রার্থিতা বাতিল করা উচিত। তাহলে কালোটাকা পেশি শক্তির প্রভাবে রোধ করা যাবে। আমরা যাকেই ভোট দেই না কেন, আমরা যদি নিজের পছন্দের মানুষকে ভোট দেই, তাহলে যে নির্বাচিত হতে পারে না, তার কাছ থেকে মার খেতেই হবে।
অনগ্রসর সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’র (অসুস) নির্বাহী পরিচালক রাজকুমার শাও বলেন, আদিবাসীদের ভোটার তালিকা নতুনভাবে করতে হবে। এ জন্য আদিবাসীদের সেই কার্যক্রমে যুক্ত করতে হবে, না হলে সঠিক হবে না। আমরা যখনই কথা বলি, তখন বিভিন্ন ট্যাগ লাগানো হয়। কখনও আওয়ামী লীগ, কখনও বিএনপি কখনো বা জামায়াত বলে ট্যাগ লাগিয়ে মারা হয়। এ জন্য আমরা টিকতে পারছি না। এটা আমাদের দুর্বলতা।