ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

২ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন লক্ষ্য ॥ দুই-একদিনের মধ্যে দরপত্র

সারাদেশে হচ্ছে ৪০ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:২০, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

সারাদেশে হচ্ছে ৪০ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র

দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪০টি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে আহ্বান

আগের ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকারও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসতে নানান পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিশেষ করে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরিতে নেওয়া হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। দেশের বিভিন্ন স্থানে ৪০টি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে আহ্বান করা হচ্ছে দরপত্র। প্রতিটি কেন্দ্র থেকে অন্তত: ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ অগ্রসর হবে। এতে করে এসব সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেই ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। 
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আজ বা কালকের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিাআর)-এর করছাড়ের প্রজ্ঞাপন (এসআরও) এবং বিশেষ আইন বাতিলে উচ্চ আদালতের রায়ের কপি হাতে পাওয়া মাত্র দরপত্র কার্যক্রম শুরু হবে। সব মিলিয়ে এই বৃহস্পতিবারেই দরপত্র আহ্বান করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন খোদ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মো. ফাওজুল কবির খান। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎ খাতে বিশেষ করে সৌরবিদ্যুতে বিপ্লব ঘটবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যেসব কোম্পানি সর্বনি¤œ দর প্রস্তাব করবে এবং সর্বনি¤œ দামে বিদ্যুৎ দিতে পারবে সেই প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দেওয়া হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারা।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নীলফামারী, সৈয়দপুর, জামালপুর, পঞ্চগড়, ঈশ্বরদী, গোপালগঞ্জ, ভালুকা, কক্সবাজার, চকরিয়া, পীরগঞ্জ, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জসহ আরও কয়েকটি অঞ্চলে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে এই দরপত্রগুলো আহ্বান করা হবে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ কেন্দ্রেরই উৎপাদন সক্ষমতা হবে ৫০ মেগাওয়াট। কোনো কোনো কেন্দ্রের সক্ষমতা সাপেক্ষে বাড়তে পারে উৎপাদনও। এক্ষেত্রে জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালনের জন্যও নেওয়া হবে ব্যবস্থা। তবে কেউই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র কাজ পাবে না।
বিগত সরকারের সময় ‘বিদ্যুৎ-জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বিশেষ বিধান ২০১০’-এর অধীনে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দেওয়া হতো। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অতিরিক্ত দরে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত সরকারের গৃহীত এমন ৪০টি প্রকল্প বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। যেগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করে গত ১৪ নভেম্বর রায় দেন হাইকোর্টও। রায়ে বলা হয়, কুইক রেন্টাল সংক্রান্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর ৯ ধারার অধীনে  কোনো কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না এবং ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে মন্ত্রীর একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার রায় দেন হাইকোর্ট।

রায়ে আদালত বলেন, দায়মুক্তি দিয়ে করা আইন অবৈধ এবং ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো ব্যক্তির একক ক্ষমতা গণতান্ত্রিক দেশে থাকতে পারে না। এটি সংবিধানের পরিপন্থি। এই রায়ের কপি এবং এনবিআর থেকে করছাড়ের প্রজ্ঞাপন হাতে পেলে বৃহস্পতিবারের মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হবে জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মো. ফাওজুল কবির খান জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। এনবিআরের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। আজ বা কালকের মধ্যেই এসআরও আমাদের হাতে এসে পৌঁছাবে। হাইকোর্টের রায়ের কপি হাতে পেলে বৃহস্পতিবারই আমরা দরপত্রের কাজ শুরু করে দিতে পারব।

তিনি বলেন, এসব কেন্দ্র তৈরিতে কোনো রকমের তদবিরে কাজ পাবে না কেউ। সবাইকে দর প্রস্তাবের মাধ্যমেই কাজ পেতে হবে। এক্ষেত্রে যার দর সবচেয়ে কম হবে তাকেই কাজ দেওয়া হবে। জমি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো কে দেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব নির্মাতা কোম্পানিকেই করতে হবে। ঠিক কত মেগাওয়াটের কেন্দ্র হবে এ বিষয়ে এখনো আমরা নিশ্চিত নই। তাই বিদ্যুতের দাম কি হবে সে বিষয়েও কোনো কথা এখুনি বলা যাচ্ছে না। 
বিগত সরকারের অধীনে গত বছরের শুরুতেই বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে ৬৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সিরাজগঞ্জ সোলার পার্ক প্রকল্পের পাওয়ার পারচেজ এগ্রিমেন্ট (পিপিএ) এবং ইমপ্লিমেন্টেশন এগ্রিমেন্ট (আইএ) সই হয়। ওইসময় জানানো হয়, এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে ডিসেম্বরে। এর কিছুদিন পর সৌর বিদ্যুতের সম্প্রসারণে ইন্টারন্যাশনাল সোলার এলায়েন্সের (আইএসএ) সঙ্গে কান্ট্রি পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট সই করে। ওই সরকার একটি সোলার রোডম্যাপও (২০২০-২০৪১) তৈরি করে।

বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইজজও)’কে ২ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১২টি ট্রলি মাউন্টেড সোলার ইরিগেশন সিস্টেম, ২ কিলোওয়াট ক্ষমতার ১২টি পোর্টেবল সোলার ধান মাড়াই যন্ত্র এবং ১.৫ কিলোওয়াট ক্ষমতার সোলার ড্রিংকিং ওয়াটার প্লান্ট সরবরাহ করার পরিকল্পনা করে আওয়ামী লীগ সরকার। এ ছাড়াও পরিকল্পনায় ছিল, ২২ কিলোওয়াট ক্ষমতার দুইটি রুফটপ সোলার স্থাপন এবং যে কোনোও একটি রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে রুফটপ সোলার প্রকল্প স্থাপন। ফ্লোটিং সোলার প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পাদন ও ফ্লোটিং সোলার প্রকল্প স্থাপনে সহায়তা। পানি বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন দুটি ম্যানুয়াল স্লুইস গেটকে ফ্লোটিং সোলারের মাধ্যমে অটো স্লুইস গেটে রূপান্তর করা।

এর বাইরেও কুড়িগ্রামের ফুলবাড়িতে একটি ৪০ মেগাওয়াট সোলার পার্ক প্রকল্পের পাশাপাশি পায়রা ৫০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র, পাবনার হেমায়েতপুরে ৩৫ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং ২৪৩ মেগাওয়াট সৌর অথবা বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জমি খোঁজা হচ্ছিল। ওইসব পরিকল্পনার কি হবে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, চলমান প্রকল্পগুলোতে তো উৎপাদন হবেই। যেগুলো বাতিল হয়েছে সেগুলো তো বাতিল। নতুন করে দরপত্রের মাধ্যমেই কাজ পাওয়া যাবে। 
অভিযোগ রয়েছে, বিগত সরকারের সময় প্রতি ইউনিট ১৮ থেকে ১৯ সেন্টেও সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়েছে। সেখানে ভারত এবং পাকিস্তানে এখন প্রতি ইউনিট সৌর বিদ্যুতের দাম তিন থেকে চার সেন্টের মধ্যে। বিগত সরকারের শেষ সময়ে এসেও ৩১ জুলাই ৫০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সোনাগাজী সোলার পাওয়ার ইউনিট লিমিটেডের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি চুক্তি হয়। ২০ বছর মেয়াদি ওই প্রকল্পের প্রতি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ধরা হয় ১০.৯৪ সেন্ট।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ২০ বছর পর্যন্ত প্রতি ইউনিট ১০ দশমিক ৯৪ সেন্ট বা ১৩ টাকায় বিদ্যুৎ কিনবে। চুক্তি স্বাক্ষরের ১৫ মাসের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এবং বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসবে বলে জানানো হয়। কিন্তু একই সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলো অর্ধেক দামে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। বর্তমানে যেসব সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি হবে সেগুলোর বিদ্যুতের দর কেমন হবে জানতে চাইলে ফাওজুল কবির খান বলেন, দরপত্র আহ্বান করা হোক। আমরা জানতে পেরেছি বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে সোলার প্যানেলের দাম কমে আসছে। প্যানেলের দাম কমে আসাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় কমবে সেটা স্বাভাবিক। আর সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আর বার বার জ্বালানিও কিনতে হয় না। এক্ষেত্রে গ্রাহকদের জন্য সহনীয় পর্যায়ের দাম যারা দিতে পারবে তারাই কাজ পাবে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সর্বশেষ তথ্যমতে দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ১৪৪টি। নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ৩১ হাজার ১৪৫ মেগাওয়াট। নতুন এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিপ্লব আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, আমরা বরাবরই বলে আসছি বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে আমদানি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তি-মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে অন্যায্য ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানে ভর্তুকি বন্ধ করে জনগণের ওপর মূল্যবৃদ্ধির চাপ কমাতে হবে।

সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে চুক্তি অনুযায়ী বিক্রয়মূল্য বেশি কেন তা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে দাম কমানোর দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের। বিগত সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চুক্তি ও সম্ভাব্য চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে বলে আমরা বলে আসছিলাম। অন্তর্বর্তী সরকার এটি আমলে নিয়েছে সেজন্য ধন্যবাদ। তবে এক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক দরে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে আর কারও দিকে আঙুল তোলার সুযোগ থাকবে না বলে আমি মনে করি।

×