ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

দুদকের জালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শিশির

প্রকাশিত: ০১:১৩, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

দুদকের জালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শিশির

আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর যখন নতুন করে সব খাতে সংস্কার শুরু হয়েছে তখন নানা অরাজকতার অভিযোগে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ হচ্ছে শিক্ষা খাত।

 

 

 

 

এই খাতে পূর্বের দুর্নীতিবাজদের শাস্তিমূলকভাবে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করা হলেও যেনো শূন্যস্থান পূরণে নতুন করে মাথাচাড়া উঠে দিয়েছেন অনেকে। তাদেরই একজন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক আবু কাইয়ুম শিশির। জাতীয়তাবাদী মতাদর্শী হয়েও এই কর্মকর্তার দুর্নীতিতে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে শিক্ষা খাত।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে চাঁদাবাজি করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। অপরাধের প্রমাণ পাওয়ার পর শাস্তিমূলকভাবে তাকে ময়মনসিংহে বদলি করা হলেও শেষ রক্ষা হয় নি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে অসুন্ধান শুরু করেছে। এমনকি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবও করেছে। কিন্তু নিজের কর্মকা-ের সত্যতা জেনেই যেনো তলবে সাড়া দেন নি এই কর্মকর্তা। 


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর শিক্ষা খাতের সংস্কার শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ আগস্ট এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছে মিনিস্ট্রি অডিট অফিস নামে পরিচিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) পরিচালক হিসেবে অধ্যাপক কাজী  মো. আবু কাইয়ুমকে নিয়োগ দেয়া হয়। ইংরেজির এই অধ্যাপক শিশির স্যার নামে সমধিক পরিচিত। তিনি দীর্ঘদিন ইডেন কলেজে ছিলেন। শিক্ষা প্রশাসনের জাতীয়তাবাদী প্যানেল থেকে প্রথম পদায়ন হিসেবে তিনি নিয়োগ পান। এই সুযোগের সদ্বব্যবহারে মেতে উঠেন তিনি। নানান বিতর্কিত কর্মকা-ে নিজেকে নিয়োজিত করার ফলে তিন মাস না যেতেই সম্প্রতি তাকে ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করা হয়।


দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তার বিরুদ্ধে জমা হওয়া অভিযোগে জানা যায়, নিজের লেখা ‘খালেদা জিয়া : এ বায়োগ্রাফি অফ ডেমোক্রেসি’ নামক একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা বলে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিনি চাঁদা দাবি করেন। এদেরই একজন রাজধানীর সিদ্বেশ্বরী এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. জুবায়েদ আহম্মেদ দীপ। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের নাম করে তার কাছে একটি খাম আসে। যেখানে লেখা ছিলো, আগামী ২৩ অক্টোবর অফিসার্স ক্লণাব ঢাকায় অধ্যাপক কাজী মো. আবু কাইয়ুম (শিশির) রচিত ‘খালেদা জিয়া : এ বায়োগ্রাফি অফ ডেমোক্রেসি’ গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন ও গ্রন্থের উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে যাচে॥ এই রঙ্গিন বইটি ১ লাখ কপি ছাপানো হবে। এবং অনুষ্ঠানটি সফল করার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা আমাদের কাছে নেই। আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পন্সবিলিটি ফান্ড থেকে বা অন্য কোনো উৎস থেকে আমাদেরকে অনুদান করলে বাধিত হবো। নিচে আবার বি. দ্র. দিয়ে খেলা হয় চেক/পে অর্ডার ছাড়া নগদ অর্থ গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে মো. জুবায়ের আহম্মেদ দীপ বলেন, এ বিষয়ে জানার জন্য অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি সরাসরি দেখা করে কথা বলতে চান। তখন আমি তার সঙ্গে দেখা করলে তিনি জানান, অধ্যাপক মো. আবু কাইয়ুম (শিশির) এর বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে কয়েশ অতিথি উপস্থিত থাকবেন। যেখানে ১ কোটি টাকার উপর খরচ হবে। তাই এটি সম্পন্ন করতে ৫ লাখ টাকা নগদ দিতে হবে। অন্যথায় আমার ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ারও হুমকি দেন তিনি। তখন আমি জানতে চাইলাম, আমার কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে, চেক অথবা পে অর্ডার ছাড়া নগদ অর্থ গ্রহণযোগ্য নয়।

এখন কেনো নগদ টাকা চাচ্ছেন। তখন তিনি আমাকে বলেন, মো. আবু কাইয়ুম শিশির বলেছেন আমার কাছ থেকে নগদ টাকা নেয়ার জন্য। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওই টাকা না দিলে আমাকে পিটিয়ে প্রাণে মেরে ফেলারও হুমকি দেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে আমি জানতে পারি, অফিসার্স ক্লাবে এ ধরণের কোনো অনুষ্ঠান হওয়ার কথা কেউ জানেনই না। তাই আমি নিজে এই কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অনুসন্ধানের জন্য দুদকে আবেদন করেছি।


এই অভিযোগে বার বারবার সময় নিয়েও দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজির হননি এই কর্মকর্তা। দুদক সূত্রে জানা যায়, সোমবারও তার দুদকে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল। দুপুরে তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছে বিকেলে উপস্থিত হওয়ার কথা জানান। কিন্তু বিকাল পাঁচটা পর্যন্তও শিশির দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হননি।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এই কর্মকর্তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নামে বই প্রকাশ করার কথা বলে বিভিন্নভাবে প্রায় ৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। এছাড়াও খালেদা জিয়ার বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ৭৭ লাখ টাকা চাঁদার মাধ্যমে আদায় করেছেন শিশির। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে শিশিরের বিরুদ্ধে।
তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, তার নিজ নামে, নিজের ডাক নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জামালপুর জেলায় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। যা সরকারি চাকরি বিধির পরিপন্থী। ঢাকা মহানগরীতেও নামে-বেনামে কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে শিশিরের।

এছাড়াও শিশিরের বিরুদ্ধে পতিত স্বৈরাচারের দোসর ও বর্তমানে কারাগারে আটক সাবেক সচিব মেজবাহ উদ্দিনকে নিরাপদে রাখার জন্য  ১০ কোটি টাকায় সমঝোতা করার অভিযোগ উঠেছে। 


শুধু তাই নয়, নিজ দপ্তরে আওয়ামী লীগের সময়ের কর্মকর্তাদের রক্ষা, আশ্রয়, অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে অশালীন আচরণ এবং প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে তাকে বদলি করা হয় বলে জানা গেছে। শিক্ষা ক্যাডার ও নিজ দপ্তরে অর্থের বিনিময়ে পদায়ন করাতে একটি বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন তিনি। এসব বিষয় মন্ত্রণালয়ের নজরে আসার পর তার বিরুদ্ধে কঠোর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।


শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাবশালী এই কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ মদদে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের একদিন আগেও ৪ আগস্ট শিক্ষাভবনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে খুনি বলে স্লোগান দেন আওয়ামীপনিন্থ কিছু কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে  বেশ কয়েকজন ডিআইএ-এর কর্মকর্তা। ডিআইএ-এর এই কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলেও পরবর্তীতে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ ছিল কাইয়ুম শিশিরের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা েেমাটা অঙ্কের টাকা লেনদেন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 


কাইয়ুম শিশিরের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, অভিযুক্তদের মধ্যে ছয়জনকে তিনি আগলে রেখে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পরিদর্শনে পাঠাচ্ছেন। এই নিয়েই মূলত দুজনের দ্বন্দ্ব শুরু।


এসব বিষয় অভিযোগের বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া না গেলেও একটি সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, ৪ আগস্ট শুধু ডিআইএ নয়, শিক্ষাভবনের অনেকেই স্লোগান দিয়েছেন। অন্য দপ্তরগুলো কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। এখন আমি যদি ব্যবস্থা নিতাম তাহলে সমালোচনা হতো। 


শুধু তাই নয় সম্প্রতি পরিচালক কাইয়ুমকে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের সদস্যপদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অসদাচরণ, ক্লাবের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থতা ও গঠনতন্ত্রের বিধি লংঘন করায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় শিক্ষাপ্রশাসনে প্রভাবশালী কমকর্তা ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের ১৬ বছর তিনি ঢাকার বাইরে ছিলেন বেশি। সর্বশেষ কুড়িগ্রামের একটি কলেজে ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ তুলে বিভাগীয় মামলাসহ নানা হয়রানি করে।

ফুয়াদ

×