.
জনগণের ভোট ছাড়া কোনো সরকারই ক্ষমতায় থাকতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের বার্ষিক সাধারণ সভায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, বিএনপি মনে করে সংস্কারের পাশাপাশি একটি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা দরকার।
তারেক রহমান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির কোনো মতপার্থক্য নেই। তবে জনগণের নিত্যপ্রয়োজন পূরণ না করতে পারলে সংস্কার কোনো কাজে আসবে না। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে কমপক্ষে ছয়জন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন। কমপক্ষে দুই হাজারের বেশি ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের সংগঠনের প্রায় চারশ’ নেতাকর্মী এই লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন।
তারেক রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ আর গণতন্ত্র একে অন্যের শত্রু। আমাদের চলমান গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করতে এই মুহূর্তে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। বিতাড়িত অপশক্তি আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরতে পারবে না।
তারেক রহমান বলেন, আমাদের চলমান গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করতে এই মুহূর্তে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। তবে বিতাড়িত অপশক্তি আর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরতে পারবে না। তিনি বলেন, নির্বাচন বিলম্বিত হলে আওয়ামী লীগের নিজের স্বার্থে তৈরি করা দেশের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলো আরও গভীর সংকটে পড়বে। তাই দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে।
তারেক রহমান বলেন, জনগণের ভোটে একটি নির্বাচিত সরকারই কেবল দেশ পুনর্গঠন বা সংস্কার কার্যক্রম শুরু করতে পারবে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্মান করতে হবে। কারণ, জনপ্রতিনিধিরাই
জনগণের সেবা করে।
তারেক রহমান বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সরকার ও জনগণ উভয় পক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। উভয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণই নিশ্চিত করবে যে, বাংলাদেশে সমতা, অন্তর্ভুক্তি এবং সার্বজনীন উন্নয়ন সম্ভব।
তারেক রহমান বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, আওয়ামী লীগ যে ভঙ্গুর ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে গেছে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য, তা ততই তীব্র হবে। সমাজে জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা ব্যবস্থা, কৃষক যে সমস্যার মুখোমুখি, ব্যবসা যে চ্যালেঞ্জের মুখে, বিচার বিভাগে এবং সরকারি কর্মক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব বিদ্যমান। এ অবস্থায় আমরা একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার পথে এগুতে পারব না। এখনই সময় জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে পুনরুদ্ধার করার এবং একটি উন্নত, শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ার পথে অগ্রসর হওয়ার।
সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা একান্ত জরুরি মন্তব্য করে তারেক রহমান বলেন, স্বৈরশাসকের সময় আমরা দেখেছি গণমাধ্যমের প্রতিটি শাখায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। লেখক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যেকোনো বিষয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে, এটি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু ভিন্নমতকে দমন ও দলাদলিতে পরিণত করলে কি হতে পারে তা গত দেড় দশকে দেশের জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। পলাতক স্বৈরাচারের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মন্ত্রী-এমপি কিংবা বায়তুল মোকাররমের খতিবসহ অনেকের পলায়নের মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হয়েছে, অবৈধ রাষ্ট্রশক্তি নয়, শেষ পর্যন্ত জনগণের রায়ই চূড়ান্ত।
তারেক রহমান বলেন, আওয়ামী স্বৈরাচারের পলায়নের পর জনগণের বিশাল আশাআকাক্সক্ষা নিয়ে যাত্রা শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে, গণতন্ত্রের পক্ষের সব শক্তি ও সাংবাদিকদের সতর্ক থাকা দরকার। চলমান গণতন্ত্রের যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে নানা রকম ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বিতাড়িত স্বৈরাচার ও তাদের দোসর নানা কৌশলে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। অপশক্তি দেশে ও দেশের বাইরে থেকে গণতন্ত্রের স্বপক্ষের শক্তির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির চেষ্টা করছে। তবে আমরা সবাই সতর্ক থাকলে দেশের স্বপক্ষের শক্তির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না বলে আমি বিশ্বাস করি। তারেক রহমান বলেন, পলাতক সরকার বিগত দিনে বিএনপিসহ বিরোধী দলের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। শত শত নেতাকর্মীকে গুম করেছে। গণঅভ্যুত্থানের সময় হাজার হাজার ছাত্রকে হত্যা করেছে। কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে।
তারেক রহমান বলেন, সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজীর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। সাগর-রুনির বিচারের বিষয়ে রাষ্ট্র উদাসীন থাকবে না- এমন ব্যবস্থা চাই। এ ছাড়া স্বৈরাচার আমলে যে সাংবাদিকরা চাকরি হারিয়েছেন, তাদের চাকরিতে ফেরত নিতে কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা গুরুত্বপূর্ণ।
তারেক রহমান বলেন, ভিন্ন মতকে শত্রুতা বা নির্লজ্জ দলাদলিতে পরিণত করলে কী পরিণতি হতে পারে তা দেশবাসী দেখেছে। তবে শেষ পর্যন্ত জনগণের রায়ই চূড়ান্ত। তিনি বলেন, বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মী ঘরছাড়া হওয়া, হাজারো হতাহত ছাত্রজনতার ত্যাগের মাধ্যমে ঐক্য গড়ে ওঠে। শহীদদের ঋণ পরিশোধ করা আমাদের দায়িত্ব। পলাতক স্বৈরাচারের পুনর্বাসন ঠেকাতে জনগণের ইচ্ছা তাদের বিচার প্রয়োজন। শুধু নির্বাচনের জন্যই আন্দোলন হয়নি। তবে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন অবশ্যই দরকার। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। একজন শুরু করবে অন্যজন চলমান রাখবে।
তারেক রহমান বলেন, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এমন হওয়া প্রয়োজন যে ইউনিয়ন থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত ভোট ছাড়া কেউ প্রতিনিধি হতে পারবেন না। ক্ষমতাসীনকে জনগণের কাছে যতটা দায়বদ্ধ রাখা যাবে রাষ্ট্র ততই শক্তিশালী হবে। সেজন্য জাতীয় সংসদ প্রয়োজন। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে বৈষম্যহীন অধিকার প্রয়োগের সুযোগ থাকতে হবে। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে সরকার, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে আমরা মনে করি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, আগামী দিনে জনগণ মালিকানা ফেরত পাবে। সে সুযোগ আমরা পেলে ৩১ দফার ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হবে। সুশাসন আছে রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফায়। জনগণকে নেতৃত্ব নির্বাচনের সুযোগ করে দিতে হবে। তবে সরকারে কিংবা সরকারের বাইরে আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখা দরকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত উত্তরণ ছাড়া পূঁথিগত সংস্কার অনেকটা অকার্যকর। সংস্কার কার্যক্রমকে কার্যকর করতে চাইলে সবার আগে জনগণের নিত্যদিনের দুদর্শা লাঘবের ব্যবস্থা করা দরকার, জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে সংস্কার র্কাক্রমের কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়া যাবে না।
তারেক রহমান বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের আগের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ কিংবা ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে দেড় দশকের বাংলাদেশ বর্তমান প্রজন্ম দেখিয়ে দিয়েছে যে, আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতা এক সঙ্গে যায় না। আওয়ামী লীগ আর গণতন্ত্র একে অপরের শত্রু। অপরদিকে বিএনপির কাছে গণতন্ত্র বা ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিরাপদ। তিনি বলেন, এমন রাষ্ট্র চাই যেখানে নিশ্চিতভাবে বাক স্বাধীনতা থাকবে।
তারেক রহমান বলেন, রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনীতির বিদ্যমান অবস্থা-ব্যবস্থার সংস্কারের লক্ষ্যে ২০২২ সালে বিএনপি প্রথম ২৭ দফা সংস্কার উপস্থাপন করেছিল। পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিকগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় শেষে ২০২৩ সালে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করে বিএনপি। বিএনপির উপস্থাপিত সংস্কার প্রস্তাবে গণমাধ্যমে স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও অভিজ্ঞ মিডিয়া ব্যক্তিদের নিয়ে একটি মিডিয়া কমিশনের কথা বলা হয়েছে। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে কাজ করছি সেখানে সাগর-রুনির বিচারের ব্যাপারে রাষ্ট্র উদাসীন থাকবে না, নিশ্চিত থাকবে মানুষের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। এই লক্ষ্য অর্জনে সকলের সহযোগিতা চাই।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে সাধারণ সভায় আরও বক্তব্য রাখেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, ঢাকা মহানগর দক্ষিনের জামায়াতের আমির নরুল ইসলাম বুলবুল, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ, সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি এম আবদুল্লাহ, বর্তমান মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী, সাংবাদিক নেতা কামাল উদ্দিন সবুজ, এম এ আজিজ, আবদুল হাই শিকদার, এলাহী নেওয়াজ খান সাজু, বাকের হোসাইন, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম, সহ-সভাপতি রাশেদুল হক, যুগ্ম সম্পাদক দিদারুল আলম সাংগঠনিক সম্পাদক সাঈদ খান প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল সালাম আজাদ, বিএনপি নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মীর সরাফত আলী সপু প্রমুখ।