.
ওয়াক-আউট বিক্ষোভ অচলাবস্থার মধ্যদিয়ে শেষ পর্যন্ত বাকু জলবায়ু সম্মেলনে অর্থায়ন বিষয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছা গেছে। এই সমঝোতায় উন্নত দেশগুলো এক দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বিপরীতে মাত্র দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন বা ৩০০ বিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে চলমান জলবায়ু সংকট মেকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলো এক লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার চেয়েছিল। তার বিপরীতে পেয়েছে মাত্র ৩০ হাজার কোটি ডলার। নির্ধারিত সময়ের পর টানা দুই রাত একদিন দরকষাকষির পর উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্র দেশগুলোকে এই অর্থ প্রদানে সম্মত হয়েছে। যা চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল।
এর আগে শুক্রবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল দরিদ্র দেশগুলোকে বছরে ২৫ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার। কিন্তু বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ এই প্রস্তাব নাকচ করে। তাদের দাবি ছিল, ক্ষতিপূরণ হিসেবে বছরে অন্তত ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার প্রয়োজন। পরে দীর্ঘ আলোচনার পর বছরে ৩০ হাজার কোটি ডলারের সমঝোতায় পৌঁছায় সব পক্ষ।
এই চুক্তি দরিদ্র দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা তাদের জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। তবে পরিবেশবাদীরা এই অর্থায়নকে ‘অপমানসূচক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তারা বলছেন, বিশ্বজুড়ে জলবায়ু সংকট সৃষ্টি করে উন্নত দেশগুলো যে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে তা ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ শামিল। রবিবার ভোরের দিকে চুক্তিতে কিছু পরিবর্তন এনে একমত হওয়া চুক্তি নিয়েও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যেই এই প্রস্তাব নিয়ে অসন্তোষ দেখা গেছে। তাদের অভিযোগ, এই বরাদ্দও অপ্রতুল।
তবে ভারতের একটি বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে যে, এখনো কিছুটা অসন্তোষ রয়ে গেছে। ভারতীয় প্রতিনিধি বলেন, আমরা এটা মেনে নিতে পারি না... প্রস্তাবিত লক্ষ্য আমাদের জন্য কিছু সমাধান করবে না। আমাদের দেশের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জলবায়ু কার্যক্রমের জন্য এটি অনুকূল নয়। অপরদিকে সুইজারল্যান্ড, মালদ্বীপ, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়াসহ দেশগুলো প্রতিবাদ করেছে যে, জীবাশ্ম জ্বালানির বৈশ্বিক ব্যবহার হ্রাস করার বিষয়ে যা বলা হচ্ছে তা আসলে খুবই দুর্বল।
২২ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় বাকু জলবায়ু সম্মেলন শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্থায়নের পরিমাণ নিয়ে তীব্র বিরোধ দেখা দেয় সম্মেলনের শেষ প্ল্যানারি অধিবেশনে। শুক্রবার রাতভর আলোচনা করেও কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি দেশগুলো। আলোচনায় মূলত বিরোধ তৈরি হয়, উন্নত দেশগুলো চাহিদার তুলনায় ক্ষতিপূরণ হিসাবে একেবারেই অপ্রতুল অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব করল। দুই সপ্তাহের এই সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহের আলোচনা শেষে উন্নয়নশীল দেশগুলোর আগামী পাঁচ বছরের জন্য প্রতিবছর ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার চেয়েছিল। কিন্তু ওই চাহিদার বিপরীতে উন্নত দেশগুলো মাত্র ২৫০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রস্তাব করলে - এ নিয়ে তীব্র বিরোধ তৈরি হয়। শুক্রবার সরাদিন শেষে সরারাতেও এ ব্যাপারে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো যায়নি। উন্নত দেশগুলো তাদের ওই প্রস্তাব নিয়ে অনড় থাকে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো এই অর্থ কোনোভাবে গ্রহণ করবে না বলে জানিয়ে দেয়। ফলে কোনো প্রকার সমঝোতা ছাড়াই প্রথম দফা আলোচনা ভেঙে যায়।
পরবর্তীতে শনিবার সকালে আয়োজক দেশ আজারবাইজানের হস্তক্ষেপে দফায় দফায় বৈঠক হয়। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে নেতৃস্থানীয় দেশগুলোকে নিয়ে একটি ক্ষুদ্র গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করা হয়। ওই বৈঠকে চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সৌদি আরব, ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রীরা যোগ দেয়। এই বৈঠকে আলোচনার পর উন্নত দেশগুলো ২৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৩০০ বিলিয়ন করার ইঙ্গিত দেয়। রুদ্ধদ্বার আলোচনার ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশ ৩০০ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবে সম্মত হয়। তবে জাপান, সুইজারল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড এর বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাব নিয়েই নতুন করে আলোচনার খসড়া দলিল (টেক্সট) প্রকাশ করা হয়।
এই প্রস্তাব নিয়েই শনিবার বিকেলে পুনরায় শুরু হয় সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশন। কিন্তু অর্থায়নের এই প্রস্তাবও গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহ। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্বল্পোন্নত দেশ ও ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো সম্মেলন থেকে ওয়াক আউট করে। শেষ পর্যন্ত তাদের বুঝিয়ে পুনরায় অধিবেশনে ফিরিয়ে আনা হয়। এ নিয়ে তীব্র বাদানুবাদের পর রবিবার ভোর বেলা ট্রিলিয়ন ডলারের আদলে নতুন অর্থায়নের লক্ষ্য নির্ধারণে সম্মত হয় উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমুহ। এ ব্যাপারে বাকু চুক্তি নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর সান্ত¡নাস্বরূপ মূল চুক্তির প্যাকেজে তাদের চাহিদা অনুযায়ী, এক দশমিক তিন ট্রিলিয়ন ডলারই (এক লাখ ৩০ হাজার কোটি ডলার) উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে উন্নত দেশগুলো প্রতিবছর দেবে ৩০০ বিলিয়ন ডলার বা ৩০ হাজার কোটি ডলার। এই অর্থ তারা দেশে অনুদান এবং সহজ শর্তের ঋণ হিসাবে। অবশিষ্ট এক লাখ কোটি ডলার আসবে বেসরকারি খাত থেকে। বেসকারি খাত বিশেষ করে তেল-গ্যাস কোম্পানি এবং উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা থেকে লেভি হিসাবে ওই অর্থ প্রদান করবে। তবে কিভাবে বেসরকারি খাত এই অর্থায়ন করবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং নি¤œ কার্বনের অর্থনীতি গড়ে তুলতে আগামী ২০৩৫ সাল পর্যন্ত এই অর্থ পাবে উন্নয়নশীল দেশগুলো।
এর আগে, ধনী দেশগুলো ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর জলবায়ু তহবিলে ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) ডলার জমা দিচ্ছিল। ওই অর্থায়নের মেয়াদ আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে শেষ হয়ে যাবে। সেখানে নতুন এই অর্থায়নের চুক্তি কার্যকর হবে।
সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে একটি বৈশ্বিক কার্বন বাজার তৈরির চুক্তিও হয়েছে। এই বাজারে ‘কার্বন ক্রেডিট’ কেনাবেচা করতে পারবে দেশগুলো। দরিদ্র দেশগুলো বৃক্ষরোপণ, বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে ‘কার্বন ক্রেডিট’ অর্জন করতে পারবে।
জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থার প্রধান সাইমন স্টিয়েল বলেছেন, ‘এটি একটি কঠিন যাত্রা ছিল, তবে আমরা একটি চুক্তিতে সম্মত হতে পেরেছি।’
তিনি অর্থায়নের এই নতুন লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি দেশের মানুষের ইন্স্যুরেন্স হিসাবে আখ্যায়িত করে বলেন, অন্যান্য ইন্স্যুরেন্সের মতো এটি তখনই কাজ করবে যখন প্রতিবছর এর পুরো প্রিমিয়াম পরিশোধ করা হবে। কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচাতে উন্নত দেশগুলোকে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
সাইমন স্টিয়েল বলেন, ‘এই চুক্তি স্বচ্ছ জ্বালানি উৎপাদনকে চাঙ্গা করবে। প্রত্যেক দেশ এই সুবিধা পাবে, তাদের কর্মসংস্থান বাড়বে, সবাই সস্তায় স্বচ্ছ বিদ্যুৎ পাবে।’
অপরদিকে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তার সমাপনী বক্তৃতায় বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলো ঋণের ভারে জর্জরিত, দুর্যোগের আঘাতে দিশেহারা এবং নবায়নযোগ্য বিপ্লবে অনেক পিছিয়ে আছে। এই অবস্থায় নতুন অর্থায়ন জরুরি ছিল। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখার জন্যও এই সম্মেলনে অর্থায়ন নিয়ে চুক্তিতে পৌঁছানো অতি প্রয়োজন ছিল। শেষ পর্যন্ত দেশগুলো অর্থায়নের নতুন লক্ষ্য নির্ধারণে সমঝোতায় পৌঁছেছে। যদিও আমি আরও বেশি উচ্চাকাক্সক্ষী সিদ্ধান্ত আশা করেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘এই সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি এবং সময়মতো সম্মান করতে হবে। প্রতিশ্রুতিকে অবশ্যই দ্রুত নগদ অর্থে রূপান্তরিত করতে হবে। আর এই নতুন লক্ষ্য পূরণে সকল দেশকে অবশ্যই একযোগে কাজ করতে হবে।’
সাহায্যের পরিমাণ ‘অপমানজনক’॥ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক খবরে বলা হয়েছে, ২৯তম সম্মেলনে জলবায়ু সংকট নিরসনে বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছে বড় অর্থনীতির দেশগুলো। এই সাহায্যের পরিমাণকে ‘অপমানসূচক‘ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন সমালোচকরা। ২৯তম জলবায়ু সম্মেলনে একটি ব্যর্থ সম্মেলন বলে দাবি করেছেন সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ।
সম্মেলনে থাকা ছোট অর্থনীতির দেশগুলো সঙ্গে সঙ্গেই এই প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করেন। জলবায়ু সংকট নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো এই অঙ্ককে ‘তামাশা’, ‘লজ্জাজনক’, ‘আপত্তিকর’ বলে মন্তব্য করে।