অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ। শনিবার দুপুরে আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচন আগে হলে সংস্কার ঝুলে যাবে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিষয়টি আমরা বিবেচনা করছি। আমরা সব সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে ভেবেচিন্তে প্রস্তাব করব। তিনি বলেন, মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণকারীরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নিতে এবং রাষ্ট্রপতি কোনো দলের সদস্য হতে পারবেন না বলে সুপারিশ করেছেন। কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আমরা এগুলো বিবেচনায় নেব। তবে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি, আমরা সব সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে ভেবেচিন্তে প্রস্তাব করব।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হওয়া উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় নাগরিক সমাজ। আমরা নাগরিক সমাজের সঙ্গে যে মতবিনিময় করেছি সেখানে সবার অভিমত হচ্ছে স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আগে হওয়া উচিত। কারণ স্থানীয় নির্বাচন করার মাধ্যমে আমাদের নতুন নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বাড়বে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা হয়ে যাবে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে যে সাপোর্ট দরকার হবে তা নিশ্চিত হয়ে যাবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন একটা আর স্থানীয় নির্বাচন পাঁচটা। পাঁচটার মধ্যে তিনটা নির্বাচন হচ্ছে- ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদ। জাতীয় নির্বাচন দেশব্যাপী হয়। আর অন্য নির্বাচনগুলো স্থানীয়ভাবে হয়। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে যদি করা হয় তাহলে যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে তা ঝুলে যাবে। কারণ এখন আমাদের যে চিন্তা-ভাবনা স্থানীয় নির্বাচন যেটা আছে সেটা কোনো সিস্টেম নয়। আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান, আলাদা আলাদা আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। কোনো ‘কমপ্রিহেনসিভ সিস্টেম’ নেই।
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, সংস্কারের বড় কাজ হবে একটা সিস্টেম ডেভেলপ করে দেওয়া। এখন সিস্টেম কি হবে সেটা দেখতে হবে। কারণ, বর্তমানে যে সিস্টেম আছে সেটা আইয়ুব খানের ভাবনা মাথায় রেখে করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পর উপজেলা পরিষদ হয়েছে। তাই একটি ভালো সিস্টেম করার জন্য এখন মোক্ষম সময়। কেননা বেশিরভাগ স্থানীয় সরকার এখন নেই। কেবল ইউনিয়ন পরিষদ আছে। কাজেই ছবি আঁকার এটাই সময়।
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা যদি সিস্টেম করতে পারি যে, একটা কম্প্রিহেন্সিভ আইন হবে, সেই আইনের মধ্যে সব প্রতিষ্ঠান চলে আসবে। এতে একটা তফসিল দিয়ে সব নির্বাচন করতে পারব। এখন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সব আলো পড়ছে মেয়রের ওপর। অন্য স্থানীয় সরকারেও একই অবস্থা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও সরাসরি মেয়র ও চেয়ারম্যান নির্বাচন হয় না। কাউন্সিলর ও মেম্বার নির্বাচন হয়। তারা পরিষদে গিয়ে নির্বাহী কমিটি তৈরি করে। আমরা তেমন সিস্টেম তৈরি করতে চাই। তাহলে নির্বাচন অনেক ‘লেস এক্সপেন্সিভ’ হবে। অনেক ব্যয় ও সময় সাশ্রয়ী হবে। এত লোকবল লাগবে কম।
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, একটা হিসাব করে আমি দেখেছি গত নির্বাচন কমিশন যে স্থানীয় নির্বাচন করেছে তাতে ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ১৯ থেকে ২০ লাখ লোকবল লেগেছে। ওই নির্বাচনে ২২৫ দিনের মতো সময় লেগেছে। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যদি পার্লামেন্টারি সিস্টেম নিয়ে আসি তাহলে ইউনিয়ন, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনে যদি একই সিস্টেমে করতে পারি তাহলে খরচ চলে আসবে ৬০০ কোটি টাকার মধ্যে। লোকবল লাগবে আট লাখ। সময় লাগবে ৪৫ দিন। তাহলে এই সিস্টেমে যাওয়ার জন্য অধ্যাদেশ করে যদি যান তাহলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব। আর বর্তমানে যা আছে তা দিয়ে যদি স্থানীয় নির্বাচন করতে চান তাহলে পাঁচটা আইন দিয়ে পাঁচটা নির্বাচন করতে হবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় সংসদের যে সদস্য তার মধ্যে স্থানীয় কোনো দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তার কাজ হচ্ছে সরকারের কাজগুলো জবাবদিহিতার মধ্যে আনা। তিনি যদি সব উন্নয়ন করেন তাহলে তো ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ হলো। তিনি জবাবদিহিতা করাবেন কাকে। সুতরাং সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা এটা পারেন।
জানা যায়, সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের শনিবারের মতবিনিময় সভায় রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নির্বাচিত, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা, হলফনামা যাচাই-বাছাই করা, কত শতাংশ ভোট পেলে নির্বাচিত হবে, ‘না’ ভোট ফিরিয়ে আনা, প্রবাসীদের ভোটের ব্যবস্থা করা, বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া যাবে না, কারচুপি, অনিয়ম এবং ভুয়া নির্বাচনের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন সংস্কার, গণমাধ্যমের মালিকানার সঙ্গে যুক্তরা নির্বাচন করতে পারবে না, ব্যবসায়িক সংগঠনে নির্বাচিত প্রতিনিধি রাখাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়। এই প্রস্তাবগুলো নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন বিবেচনা করবে বলে আশ্বাস দেওয়া হয়।