রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তা দখল করে বিক্ষোভ
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তা দখল করে বিক্ষোভ, অবরোধ, মিটিং, মিছিল, ঘেরাওয়ের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, বাড়ছে জনদুর্ভোগ, ক্ষতি হচ্ছে অর্থনীতির। গত ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনরোষের শিকার পুলিশের মনোবল এখনো পুরাপুরি চাঙ্গা হয়নি। পুলিশ সদস্যদের এখনো আতঙ্ক কাটেনি। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এখনো আগের মতো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না পুলিশ।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গত ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে বাহারুল আলম ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নতুন কমিশনার পদে শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখনো দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টার ক্ষেত্রে একমাত্র ভরসার জায়গা হিসেবে কাজ করছে সেনাবাহিনী।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রায় প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের কোথাও না কোথাও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রধান সড়ক অবরোধের কারণে যানজট অলিগলিতে ছড়িয়ে সৃষ্টি হচ্ছে জনদুর্ভোগ। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলেও বিক্ষোভ বা অবরোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে পুলিশকে সহযোগিতার জন্য ডাকতে হয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের। কারণ দাবি-দাওয়া নিয়ে উত্তপ্ত ও উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে অনেক জায়গায় নিম্নপদস্থ পুলিশ সদস্যরা উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করতে চাইছেন না।
উচ্ছৃঙ্খলতাকে যেভাবে কঠোর হস্তে দমন করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন ঠিক সেই ধরনের কঠোরতা দেখা না যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়ে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। তারপর আবার কোনো ক্ষেত্রে কোনো ঘটনায় কঠোর হলেই সাধারণ মানুষ জোটবদ্ধ হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে দিচ্ছে। এতে পুলিশ সদস্যদের মনোবল আরও ভেঙে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেককেই সরিয়ে দেওয়া হয়।
তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর করাগারে পাঠানো হয়েছে, বর্তমানে তিনি কারাবন্দি। এ ছাড়া ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান হত্যা মামলার আসামি হয়ে এখন পলাতক। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর গত ৭ আগস্ট আইজিপি হিসেবে মো. ময়নুল ইসলাম ও ডিএমপি কমিশনার হিসেবে মাইনুল হাসানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর গত ২০ নভেম্বর তাদের পরিবর্তে পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে বাহারুল আলম ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নতুন কমিশনার পদে শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে আইজিপি, ডিএমপি কমিশনারই নয়, পুলিশের শীর্ষ পদগুলোতে ব্যাপক বদলি করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সড়কে বিক্ষোভ শুরু করে। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে গার্মেন্ট শ্রমিকরা বকেয়া বেতনসহ বিভিন্ন দাবিতে ভাঙচুর, ঘেরাও, বিক্ষোভ, মিটিং, মিছিল করলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপে গার্মেন্টস সেক্টর শান্ত করা হয়। তারপরও মাঝে-মধ্যেই বিভিন্ন স্থানে গার্মেন্টস শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে দাবি-দাওয়া জানাচ্ছে। সম্প্রতি আনসাররা দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয় ঘেরাও, অবরোধ করলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে।
ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও সচিবালয় এলাকায় বিক্ষোভ ও মিছিল-মিটিংও নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ডিএমপির এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও মিছিল বা বিক্ষোভ চলতে থাকে। গত কয়েকদিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন। সেটি সমাধান করতে না করতেই তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এর আগে ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেছেন। এরপর তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে সায়েন্স ল্যাব এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
একইদিন সকালে যাত্রাবাড়ী এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার মালিকরাও সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছেন। এরপর রাজধানীর জুরাইনে রেললাইন অবরোধ করে ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালকরা সড়ক অবরোধ, মিটিং, মিছিল করেছে এবং দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার জন্য তারা আল্টিমেটাম দিয়েছেন। প্রায় প্রতিটি আন্দোলনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছে সেনাবাহিনী।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ বাহিনীতে ঢালাও বদলির ফলে রাজধানীতে দায়িত্ব পালন করতে আসা অধিকাংশ পুলিশ সদস্য ঢাকা শহরের অলিগলি চেনেন না, বিভিন্ন জেলা পুলিশের সোর্সের অভাব, কাজের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সঙ্গে তাল মিলাতে পারছে না, জনবল ও গাড়ি সংকটসহ নানা অসুবিধার কারণে পুরাপুরি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ। বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন স্থানে এসে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের বেশিরভাগেরই বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা মোকাবিলার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এ ছাড়া পটপরিবর্তনের কারণে কেউ নিজে থেকে কঠোর পুলিশি অ্যাকশন নেওয়ার জন্যও নির্দেশনা দিতে চাইছেন না। এই সুযোগেই বিভিন্ন গোষ্ঠী সড়ক অবরোধ করে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যেও হতাশা রয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের ডাকে সাড়া দিতে চাইছে না সাধারণ মানুষ। পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ভয়ও ভেঙে গেছে। ফলে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশকে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়। ধীরে ধীরে এই অবস্থার উন্নতি হলেও এখনো পর্যন্ত আগের মতো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না পুলিশ। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে ডাকতে হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলির ঘটনায় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছেন। সম্প্রতি আবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে জুলাই আন্দোলনে ডিএমপিতে মাঠ পর্যায়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের তথ্য চাওয়া হয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্য কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত রয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে কঠোর অ্যাকশনে যাওয়ার কথা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যেসব পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা, বেতন বন্ধ, পাসপোর্ট বাতিলসহ নানা ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পাঁচ শতাধিক থানা পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, লুটপাট-ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরপর পুলিশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে অন্তর্র্বর্তী সরকারের সংস্কারের উদ্যোগের মধ্যে ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করাসহ বদলি করা হয়। তবে এখনো আগের মতো স্থিতিশীলতা ও কর্মদক্ষতায় ফিরতে পারেনি পুলিশ। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির দিকে গেলেও পুরাপুরি সন্তোষজনক উন্নয়ন হয়নি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলেও সন্তোষজনক নয়। একইসঙ্গে ঢাকার প্রায় সব পুলিশকে পরিবর্তন করা হয়েছে বিধায় তাদের অলিগলি চিনতে ও ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ক্রিমিনালকে কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া যাবে না। সে যত প্রতাপশালীই হোক না কেন। আগে অনেক সময় অনেক প্রতাপশালী অপরাধী ছাড় পেয়ে যেত। সেটা আর হতে দেওয়া যাবে না।
রাজধানীর পিলখানাস্থ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তর পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের থেকে একটু উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আরও উন্নতি হওয়া দরকার। খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে যে চলে গেছে তা না। এখন যদি বলেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন? সেটা জাস্ট সন্তোষজনক। কিন্তু এটা আরও ভালো হওয়া দরকার।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ৫ আগস্টের পর থেকে পুলিশ ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে উঠছে। এখন নিয়মিত টহল ও চেকপোস্টও পরিচালনা করা হচ্ছে। ট্রেডিশনাল ক্রিমিনালদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন করা হচ্ছে। যথাযথভাবে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু পুলিশকে শতভাগ সক্রিয় করতে হলে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্যই পুলিশ গঠিত হয়েছে। ফলে নাগরিকরা যদি পুলিশকে সহায়তা করে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ তালেবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্রতিনিয়ত বোঝানোর চেষ্টা করছি যে যদি কারও কোনো যৌক্তিক দাবি থাকে তাহলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। কারণে-অকারণে সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। পুলিশের অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি উত্তপ্ত পরিস্থিতির উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ন্ত্রণ করা এখন পুলিশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু পুলিশ সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে।