.
দরপত্র বাতিল, পুনর্দরপত্র আহ্বান ও বইয়ের বিভিন্ন কন্টেন্ট পরিবর্তন করে আগামী শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়াসহ নানা চ্যালেঞ্জে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। দেরিতে শুরু করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে এখন এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদেরও ব্যস্ত সময় কাটছে। ছাপাখানা মালিকরা অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন পুনর্দরপত্র ও দেরিতে কার্যাদেশ অনুমোদনের কারণে নতুন বই জানুয়ারির এক তারিখে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এনসিটিবি বলছে জানুয়ারির এক তারিখেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই চলে যাবে। যদি কোনো ছাপাখানা মালিক এর ব্যত্যয় করে তবে সরাসরি পারচেজের (ডিপিএম) মাধ্যমে আর্মি প্রিন্টিং প্রেস বই ছাপিয়ে বই সরবরাহ করবে। এর ফলে পুস্তক প্রেস মালিকদের কপালে যে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান ড. রিয়াজুল হাসান জানান, চলতি মাসের নভেম্বরের মধ্যেই ৭০টি লটে প্রায় ৪ কোটি বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। এই লটে রয়েছে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বই। এরমধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ অন্যান্য বইয়ের কাজও শেষ হবে। প্রাথমিকের অন্য যে লটের বই বাকি থাকবে, অর্থাৎ চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই- সেটিও ডিসেম্বরের ২০ তারিখের মধ্যে জেলা উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।
প্রতিবছর জুন মাসে বই ছাপার প্রক্রিয়া শুরু হলেও এবার তা হয়নি। যে কারণে শেষ সময়ে যে কাজের চাপ বাড়বে- সেটি নিয়ে মুদ্রাকর, পুস্তক প্রেস মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তাদেরও কোনো দ্বিমত নেই। কারণ নভেম্বরের শেষ সপ্তাহেও নবম ও দশম শ্রেণির বইয়ের দরপত্রের কাজই শেষ হয়নি।
এ বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান জানান, অনেক প্রতিষ্ঠান দরপত্রের মধ্য দিয়ে কাজ পেয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তাদের কাজের মান খারাপ। বা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারবে না। এমনটি দেখলে বসে থাকবে না বোর্ড। সেক্ষেত্রে ডিপিএমের (ডিরেক্ট পারচেজ ম্যানেজমেন্ট) মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে বই ছাপানোর কাজ দেওয়া হবে। এ বছর যদিও তারা এক কোটি বই ছাপানোর কাজ করছে। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে তাদেরকে আরও ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি বই ছাপানোর দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
বইয়ের মান ভালো হবে, নেওয়া হচ্ছে ব্যবস্থা ॥ গত কয়েক বছর অসাধু ব্যবসায়ী ও সরকারের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় নিম্নমানের বই দেওয়ার চল শুরু হয়েছিল। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় সিন্ডিকেট। কিন্তু এবার এই সিন্ডিকেট ভাঙতে চাইছে এনসিটিবি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বই উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের সবকিছুই ছিল প্রেস মালিকদের হাতে। তারাই নিম্নমানের বই ছাপত। তাদের কোম্পানিই মান সঠিক বলে ছাড়পত্র দিত। এক্ষেত্রে এনসিটিবির দায়িত্বশীলদের অবহেলাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে এনসিটিবি চেয়ারম্যান জনকণ্ঠকে বলেন, আগে যারা অসৎ প্রেস মালিক ছিল তাদেরকে জরিমানা বা তিরস্কার না করে বরং পুরস্কার দেওয়া হতো। ছোটখাটো কিছু প্রেসকে লোক দেখাতে কালো তালিকাভুক্ত করত। এবার এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে চায় এনসিটিবি। এরই মধ্যে আনন্দ পাবলিশার্স নামের একটি কোম্পানির যন্ত্রাংশের ত্রুটি ও কাজের মানের কারণে শোকজ করা হয়েছে। এই পাবলিশার্সটি আওয়ামী লীগ আমলের সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ভাই রাব্বানী জব্বারের। দীর্ঘদিন তারা পাঠ্যবইয়ের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত ছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। এনসিটিবি বলছে ৬ষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের কাজও দুর্দান্ত গতিতে চলছে। নবম ও দশম শ্রেণির দরপত্রের কাজ শেষ করে এটিও দ্রুত ছাপা হওয়া শুরু হবে।
তবে এ বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ছাপাখানা মালিকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলছেন, এনসিটিবি মনে করছে কম্পিউটারে একটি টিপ দিলেই বই ছাপা হয়ে বের হয়ে যায়। বিষয়টি এত সহজ হবে না। সময় না দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বই হাতে পাওয়ার বিষয়টি অকেকটা মেঘ না চাইতে জলের মতো।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান জানান, বিনামূল্যের বইয়ে কাগজের যে উজ্জ্বলতা ও যে মান দেওয়ার কথা, বিগত সালগুলোতে তা দেওয়া হচ্ছিল না। এবার প্রাথমিকের চার রঙা বইয়ের উজ্জ্বলতা ৮৫ জিএসএম (গ্রাম পার স্কোয়ার মিটার) ও মাধ্যমিকের ৮২ জিএসএম দরপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। বিগত সময়েও এমন ছিল। কিন্তু সেটির বাস্তবায়ন ছিল না। যে কারণে বিনামূল্যের এসব বই ৬ মাস ৮ মাসেই পড়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ত। কিন্তু এবার আশা করা যাচ্ছে বইয়ের মান ভালো হবে। এ বিষয়ে এনসিটিবির আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকা উচিত বলেও তিনি মনে করেন।
বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে সঙ্গে খরচও ॥ গত বছরের চেয়ে এবার পাঠ্যপুস্তক ছাপাতে ৭৮৩ কোটি টাকা বেশি খরচ হবে। এর জন্য এনসিটিবি দশম শ্রেণির বই ছাপানোর বিষয়কে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছর ১০ম শ্রেণিতে কোনো বই ছিল না। এর আগে সৃজনশীল পদ্ধতিতেও ১০ম শ্রেণিতে বই লাগত না। নবম-দশম পাঠ্যবই একই ছিল। এবং সেটি পড়েই শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিত। কিন্তু এবার দশম শ্রেণির জন্য অতিরিক্ত সোয়া ৫ কোটি বই ছাপাতে হচ্ছে। যার জন্য খরচ পড়বে অন্তত সাড়ে ৪শ কোটি টাকা। তবে আগামীবার দশম শ্রেণির জন্য আলাদা বই ছাপাতে হবে না বলেও সংশ্লিষ্টরা জানান।
হবে না বই উৎসব, বই পাওয়া যাবে অনলাইনে ॥ প্রতি বছরের মত ঘটা করে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া হলেও আগামী বছরের জানুয়ারির এক তারিখে বই উৎসবের আয়োজন করছে না এনসিটিবি। ডিসেম্বরের ৩০ বা ৩১ তারিখ এনসিটিবি তাদের ভবনে সংবাদ সম্মেলন করবে বলে জানানো হয়েছে। এদিন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ও সাংবাদিকরা উপস্থিত থাকবেন বলে এনসিটিবির পরিকল্পনায় রয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার আগেই এনসিটিবির ওয়েবসাইটে সব শ্রেণির বইয়ের পিডিএফ ফাইল আপলোড করা হবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এই বই পড়ে তাদের মতামত জানাতে পারবেন। এ ছাড়া কোনো ভুলত্রুটি থাকলে সে বিষয়েও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।