.
অবশেষে দেশ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি বা এর আগে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। নতুন ইসি রবিবার দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুতই ভোটার তালিকা প্রণয়নসহ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করবে। সরকার গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিটিও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরের মধ্যেই সুপারিশ পেশ করবে। রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে।
বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি দ্রুত নির্বাচন। সরকারও সংস্কার শেষে নির্বাচনের কথা বলছে। ইতোমধ্যেই সার্চ কমিটির সপারিশ করা ১০ জনের মধ্য থেকে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। ৫ সদস্যের নির্বাচন কমিশনে সাবেক সচিব এএমএম নাসির উদ্দীনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নিয়োগ করা হয়েছে। আর নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব তাহমিদা আহ্মদ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। রবিবার প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিয়ে তারা দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই এই কমিশন সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করেছে। সেই সঙ্গে কমিশন গঠনের পর নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক কার্যক্রম নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। রবিবার থেকেই নতুন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা নিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক কার্যক্রম জোরদার করা হবে বলে ইসি সূত্র জানায়।
এদিকে নিয়োগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে নতুন সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন বলেছেন, ‘দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে না পারলে বেইমানি হবে। এত রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করব। জীবনে কোনোদিন আমি ফেল করিনি। আশা করি এবারও ফেল করব না।’
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করে সিইসি বলেন, ‘সব বড় বড় দল সুষ্ঠু নির্বাচন চাচ্ছে। আশা করি, তারা তাদের কথা রাখবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন থেকে আমরা যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তুত থাকব। আমরা স্বাধীন ও ষোলো আনা নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করব।’
নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সোচ্চার হয় তখন অতিসম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের নৌ-পরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি বা এর আগে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। তিন মাসেরও বেশি সময় পর হলেও সরকারের একজন উপদেষ্টা নির্বাচনের টাইম লাইন সম্পর্কে ধারণা দেওয়ায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এটিকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। সেই সঙ্গে নিজ নিজ দলের নেতাকর্মীদের মাঠে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
নির্বাচন কমিশন গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করেছে। দলের সিনিয়র নেতারা বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও মহানগর সফরে গিয়ে সভা-সমাবেশ করছেন। প্রতিটি সংসদীয় এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীরাও গণসংযোগ জোরদার করছেন। এ ছাড়া বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাইও শুরু করে দিয়েছে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর থেকেই দেশ ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করার কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে নতুন নির্বাচন কমিশনকে। নির্বাচন আইনের বাধ্যবাধকতার অংশ হিসেবে প্রতি বছরের ২ জানুয়ারি ভোটার তালিকার খসড়া প্রকাশ করা হয়। তার আগে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হয় ইসিকে। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনের আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে হয়। আইন অনুযায়ী ভোটার তালিকা হালনাগাদের খসড়া ও চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের দায়িত্বও ইসির। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই নতুন ইসি এসব কাজ শেষ করবে। তবে এই ইসি প্রবাসীদের ভোটার করার বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে দেখবে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়।
উল্লেখ্য, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগের এক মাসের মাথায় গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। ২০২২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পাওয়া সিইসি ছাড়াও পদত্যাগ করা অন্য কমিশনাররা হলেন- ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আহসান হাবীব খান, বেগম রাশেদা সুলতানা, মোহাম্মদ আলমগীর এবং আনিছুর রহমান। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ওই নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এসেই রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে জোর দেন। আন্দোলনে সফল ছাত্র-জনতাও সংস্কারের ওপর জোর দেন। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও সংস্কারের কথা বলে। তবে এক মাস পর থেকেই বিএনপি সংস্কারের পাশাপাশি দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাতে থাকে।
বিএনপি তাদের সমমনা দলগুলোকে নিয়ে দেড় বছরেরও বেশি সময় আগে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিলেও অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত নির্বাচন ও পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানায়। সেই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের ৩ মাস অতিক্রমের পর বিএনপি পুরোদমে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করে। আপাতত নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প চিন্তা করছে না দলটি। তাই দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা।
সূত্র মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর দেশের নির্বাচনী মাঠ এখন বিএনপির অনুকূলে। তাই দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা চাচ্ছেন এই পরিবেশ থাকতে থাকতেই যেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যায়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারবে- এমন আশা থেকেই তারা দ্রুত নির্বাচন চান। আর ভোটের আগ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠ নিষ্কণ্টক রাখতে দলের সকল কেন্দ্রীয় নেতা এখন সারাদেশের বিভিন্ন মহানগর, জেলা ও উপজেলা চষে বেড়াচ্ছেন। তারা সভা-সমাবেশে নির্বাচনের পক্ষে বক্তব্য রাখার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে জনসংযোগ কর্মসূচি জোরদার করছেন। এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অধিকতর সক্রিয় করে সংসদ নির্বাচনের পথ সুগম করছেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ৩০০ সংসদীয় আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে। নির্বাচনের আগে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা যেন দলীয় কর্মকান্ডে অধিকতর সক্রিয় হয় তারই অংশ হিসেবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রায়ই ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিটি সংসদীয় এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। বিএনপি ছাড়াও আরও বেশ ক’টি দল নির্বাচনের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবির পরও অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কাজ নিয়ে পুরোদমে ব্যস্ত সময় পার করছে। এ জন্য বেশ ক’টি কমিশন গঠন করেছে। কমিশনগুলো হচ্ছে, সংবিধান পুনর্গঠন কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, পুলিশ বিভাগ সংস্কার কমিশন, প্রশাসন সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সংস্কার কমিশন ইত্যাদি। কমিশনগুলো তাদের কাজ শেষ করতে দফায় দফায় বৈঠক করছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই কমিশনগুলো সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে দেবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জনগণের আশা দ্রুত নির্বাচন। তাই আমরাও চাই দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। তাই আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বলছি নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কাজ শেষ করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে। নির্বাচনের পর জনপ্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে বাকি সংস্কারগুলো করা হবে। সমগ্র দেশের মানুষ এখন নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।’
ইসি সূত্র জানায়, নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর দ্রুতই যাতে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারেন সে জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম এগিয়ে রাখা হয়েছে। তাই কমিশন চাইলে দ্রুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে।