বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার চায় উন্নয়নশীল দেশগুলো
জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে অর্থায়ন নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো আগামী পাঁচ বছরের জন্য প্রতি বছর ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার চাইছে। কিন্তু এই অর্থ কারা দেবে, কীভাবে দেবে- এই প্রশ্নে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিরোধ চরমে পৌঁছেছে। সম্মেলনের আর একদিন বাকি থাকলেও, এই দুই মেরুর দূরত্ব কমানোর জোরালো কোনো প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। বরং আয়োজক দেশ আজারবাইজান এখন সম্মেলনকে সফল দেখাতে ভিন্ন সুর তুলেছে। তারা সম্মেলনে সফল দেখানে শীর্ষ এজেন্ডা অর্থায়নকে পাশ কাটিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা কার্বন ট্রেডিং বা কার্বন বাণিজ্যের ঐক্যমত্যকে সম্মেলনের সাফল্য হিসাবে দেখাতে চাইছে।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ কমাতে কার্বন বাণিজ্যের বিধানও রাখা হয়েছে। সেই চুক্তি স্বাক্ষরের নয় বছর পর সম্মেলনের প্রথম দিনেই আয়োজন দেশ কৌশল প্রয়োগ করে এই কার্বন বাণিজ্যের নিয়ম-কানুব বা বিধি-বিধান অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে। ফলে অর্থায়ন নিয়ে চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ক্ষীণ দেখে আজারবাইজান কার্বন ট্রেডিংকে কার্যকর করার এই সিদ্ধান্তকেই সম্মেলনের সফলতা হিসাবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার পরিকল্পনা করছে।
আজ শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা দুই সপ্তাহব্যাপী চলা এবারের ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন। সেখানে মূল এজেন্ডা হিসাবে রয়েছে- জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহকে অর্থায়নের লক্ষ্যে নিউ কালেকটিভ কোয়ান্টিফাইড গোল (এনসিকিউজি) এর আওতায় একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। কিন্তু দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, এই চুক্তির বিষয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছানোর আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে সময় বাড়িয়ে অর্থায়নের চুক্তিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে জাতিসংঘের জলবায়ু সংস্থা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখার কথা যে আয়োজক দেশের-সেই আজারবাইজানের এ ব্যাপারে জোরালো কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। এতে তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়েছে দেশটির নেতৃবৃন্দ।
পরিবেশবাদী গ্রুপ এবং পর্যবেক্ষকরাও অনুধাবন করছেন, এই বছর অর্থায়ন চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব না হলে, অদূর ভবিষ্যতে এই চুক্তিতে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, আগামী জানুয়ারিতে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে বিশ্ব ব্যবস্থা পাল্টে যেতে পারে ট্রাম্প আবার জলবায়ুবিরোধী ব্যক্তি হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। তিনি দায়িত্ব নিয়েই হয়তো জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবে। ফলে ভবিষ্যতে অর্থায়ন নিয়ে কোনো চুক্তিতে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়বে। ফলে যে কোনো মূল্যে এই বছরই অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
গত বছর (২০২৩ সালে) দুবাই জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম দিনেই নিজ থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে আগের বছর মিসরের শার্ম আল শেখে অনুমোদন পাওয়া লস এন্ড ডেমেজ ফান্ডকে কার্যকর করেছিল আরব আমিরাত। এ বছর সেই একই স্টাইলে প্রথম দিনের উদ্বোধনী অধিবেশনে কার্বন ট্রেডিং এজেন্ডা অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যদিয়ে প্যারিস চুক্তির ৬.৪ আর্টিকেলে উদ্বৃত কার্বন ট্রেডিং কীভাবে কাজ করবে তার নিয়ম-কানুন অনুমোদন পেয়েছে। যদিও অনুমোদনের এই প্রক্রিয়া নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ টুভালোর মতো ক্ষতিগ্রস্ত অনেক দেশ বলছে, কোনো প্রকার আগাম আলোচনা ছাড়াই প্রথম অধিবেশনে প্রস্তাব এনে এটি অনুমোদন করানো বিধিসম্মত হয়নি। এখনো এ সংক্রান্ত জাতিসংঘের সুপারভাইজরি বডিতে এই প্রস্তুব অনুমোদন পায়নি। অথচ তার আগেই এটিকে তড়িঘড়ি অনুমোদন করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে ব্যাকডোর ‘অ্যাচিভমেন্ট’ বা ‘পেছনের দরজার অর্জন’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, ১২ সদস্যের সুপারভাইজরি বডি সবেমাত্র কার্বন ট্রেডিং কে কার্যকর করার জন্য এর নিয়ম-কানুন ঠিক করেছে। এই নিয়ম-কানুনে দুটি বিষয় রয়েছে। একটি হচ্ছে- কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য কীভাবে সুযোগ তৈরি করবে, অন্যটি হচ্ছে- কীভাবে অর্থায়নের ব্যবস্থা করা হবে। সুপারভাইজরি বডির কর্মকর্তারা আরও বলছেন, এটি আরও আলোচনার মাধ্যমে এই বডিতে অনুমোদনের পর জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই আয়োজক দেশ সেটিকে উদ্বোধনী পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে। অবশ্য এখনো সময় আছে, শেষ দিনের চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে এটি পুনরায় অনুমোদন করার।
কার্বন ট্রেডিংকেও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে জলবায়ু অর্থায়নের একটি উৎস হিসাবে দেখা হচ্ছে। কার্বন ট্রেডিং হচ্ছে- উন্নত দেশ বা আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য অর্থ প্রদান করবে। সেই অর্থের বিনিময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো বায়ুম-ল থেকে ওই নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্বন কমাবে। নানাভাবে এই কার্বন ট্রেডিং হতে পারে। যেমন- বাংলাদেশের সুন্দরবন প্রতি বছর যে পরিমাণ কার্বন শোষণ করে সেই কার্বন কমানোর বিনিময়েও বাংলাদেশ প্রতি বছর উন্নত কোনো দেশ বা কোনো কোম্পানি থেকে অর্থ পেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় কার্বন নিঃসরণ কমানোর মাধ্যমে প্রতি বছর ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হতে পারে। তবে এটি পুরোপুরি কার্যকরের জন্য সম্মেলনের শেষ দিনে চূড়ান্ত অধিবেশনে অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে।
শেষ মুহূর্তে অর্থায়নের চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব না হলে এই কার্বন ট্রেডিংকেই এবারের সম্মেলনের অর্জন হিসাবে দেখানোর পরিকল্পনা করছে আজারবাইজান। কারণ, জলবায়ু সম্মেলনের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে বিপদাপন্ন দেশগুলোর জলবায়ু অর্থায়ন এক কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বে জলবায়ু বিপর্যয়ের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে জলবায়ু অর্থায়নের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সেই চাহিদা অনুযায়ী যোগান বাড়ছে না। ফলে চাহিদা ও যোগানের মধ্যকার ব্যবধান দৃশ্যমান হচ্ছে। সেই বাস্তবতার আলোকেই অর্থায়নের খসড়া দলিলে (টেক্সট) সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে।
খসড়া ট্রেক্সটে ২০২৬ সাল থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত অর্থায়নের জন্য ৫ থেকে ৬.৮ ট্রিলিয়ন ডলার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে নিউ কালেকটিভ কোয়ান্টিফাইড গোল (এনসিকিউজি) এর আওতায় প্রতি বছর উন্নত দেশগুলোকে এক থেকে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই অর্থ উন্নয়নশীল দেশগুলো নিজস্বভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানো, নির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচির মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানি প্রতিস্থাপনের জন্য।
খসড়া প্রস্তাবে অর্থায়নের দুটি অপশনের কথা তুলে ধরা হয়েছে। একটি হচ্ছে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৫-৭ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়ন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- প্রাক-২০৩০ সাল পর্যন্ত ৫-৬.৮ ট্রিলিয়ন ডলার প্রদান। এছাড়া অভিযোজন বা অ্যাডাপটেশনের জন্যও অর্থায়নের দুটি অপশন রাখা হয়েছে। একটি হচ্ছে- ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ২১৫-৩৮৭ বিলিয়ন ডলার প্রদান এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে- একই সময়ে প্রতি বছর ৪৫৫- ৫৮৪ বিলিয়ন ডলার প্রদান।
খসড়ায় আরও একটি বিধান উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে- উন্নত দেশগুলো ২০০৯ সালে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ২০২০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই অর্থায়ন করবে উন্নত দেশগুলো। কিন্তু তারা এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি তা ওই খসড়ায় স্বীকার করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এবং প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ দিতে পারেনি, তা বকেয়া হিসাবে প্রদানের ব্যাপারে নতুন করে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। যদিও উন্নত দেশগুলো দাবি করছে, তারা ২০২২ সালে ১১৫ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করেছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু সংকট মোকাবিলার জন্য।
উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন খসড়া টেক্সটের ভিত্তিতে জলবায়ু অর্থায়ন হিসাবে উন্নত দেশগুলোর কাছে প্রতি বছর ১.৩ বিলিয়ন ডলার প্রদানের চাপ দিচ্ছে। তাদের দাবি হচ্ছে- এই অর্থ আসতে হবে সরকারি অর্থায়ন এবং অনুদান হিসাবে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো এই পরিমাণ অর্থ দিতে চাইছে না। তার পরিবর্তে তারা নানা ধরনের পরিসংখ্যান তুলে ধরছে। আবার তাদের মূল কথা হলো- জলবায়ু অর্থায়ন হতে হবে বেসরকারি খাত থেকে। বহুজাতিক ব্যাংকগুলো এই অর্থায়ন করবে। তারা জলবায়ু অর্থায়নে চীনের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও ভূমিকা রাখার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। ফলে অর্থায়ন নিয়ে আলোচনায় উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে চরম মতভেদ বিরাজ করছে। ফলে শেষ দিনে এই মতভেদ দূর করে অর্থায়নের ব্যাপারে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো বাকু সম্মেলনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।