ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

তিনি আইন তিনিই আদালত

প্রকাশিত: ২১:০০, ২১ নভেম্বর ২০২৪; আপডেট: ২১:২৪, ২১ নভেম্বর ২০২৪

তিনি আইন তিনিই আদালত

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

মাফিয়া রাষ্ট্র” বলতে আমরা সাধারণত এমন সরকারের কথা বলি, যা কিনা নিজেই অপরাধকে ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত এই ব্যক্তিদের হাত থাকে সবখানে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হল সহিংসতা।

 

 

 

অন্যদিকে ক্লেপটোক্রেসি বা চৌর্যতন্ত্রের হল, এমন সরকার যা হরহামেশা দেখা যায়, যাদের সঙ্গে চুরি ও ব্যাপক মাত্রার দুর্নীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। উন্নয়নশীল বিশ্বে বেশিরভাগ সরকারই দুর্নীতিগ্রস্ত। তবে সম্ভবত ছয় বা সাতটি মাফিয়া রাষ্ট্র আছে, যাদের লক্ষ্য মাফিয়া-ধাঁচের সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া চৌর্যতন্ত্রের ভিত্তিতে নয়।

কসোভো এবং মন্টিনেগ্রো উৎকৃষ্ট মাফিয়া রাষ্ট্রের উদাহরণ। ইকুইটোরিয়াল গিনিও তেমনই। ভেনেজুয়েলা অবশ্যই মাফিয়া রাষ্ট্র, কারণ দেশটির কর্মকর্তারা আর রাষ্ট্র পরিচালনায় আগ্রহী নন। সেখানকার অভিজাত রাজনৈতিক শ্রেণী এবং সামরিক বাহিনী আর নিরাপত্তা বা শিক্ষাখাতের উন্নয়নে কাজ করে না, বরং অফশোর অ্যাকাউন্ট খোলা এবং ড্রাগ ব্যবসায় ব্যস্ত থাকে। মাল্টা এবং মেক্সিকোকেও এই কাতারে ফেলা যায়।

অন্যদিকে, শক্তিশালী গণতন্ত্র নেই, এমন সবখানেই  চৌর্যতন্ত্রের দেখা মেলে। অবশ্য বিশ্বের বেশিরভাগ  জায়গাই এমন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আফ্রিকার কথা। এখানকার সিংহভাগ দেশে স্বৈরতন্ত্র চলে, ভোট জালিয়াতি হয়, আর খেসারত দেয় জনগণ। এটি পুরোপুরি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা নির্ভর একটি ব্যবস্থা।

যেমন: আজারবাইজানকে বলা যায়  চৌর্যতন্ত্র। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বৈরতান্ত্রিক দেশ। তারা জনগণকে দমনপীড়ন করে, আর চুরির অধিকাংশ অর্থ খরচ করে বাকিদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে, যেন তারা ক্ষমতাসীন পরিবারের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়। তারা সবকিছু চুরি করে। অবশ্য এর কারণ অভাব নয়। বরং তারা চায় না, তাদের বিরোধিতা করার মত অর্থ কারো কাছে থাকুক।

বিগত সরকারের আমলকেও অনেকে এখন তুলনা করছেন রাষ্ট্রের মাফিয়া বিজনেস এর সাথে সাথে চৌর্যতন্ত্রের ্উৎকৃষ্ট শাসন বলতে চাইছেন তারা।

শেখ হাসিনা বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলন করতেন, সেই সফর গুরুত্বপূর্ণ অথবা গুরুত্বহীন, যাই হোক না কেন।সেটা ছিল একধরণের স্বেচ্ছাচারীতা।হাসিনা তার সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমার বাসার কাজ করে গেছে পিয়ন, সে এখন ৪০০ (চারশ) কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না।৪০০ কোটি টাকার সম্পদ করেছে বাসার কাজের লোক, তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে না দিয়ে শেখ হাসিনা পিয়নকে নিজেই শাস্তি দিয়েছেন। এর অর্থ দাঁড়ায় তিনি আইন তিনিই আদালত’।

দুর্নীতির বিষয়ে সরকার জিরো টলারেন্সে বিশ্বাসী বারবার এ কথা উচ্চারণ করা শেখ হাসিনার মন্ত্রী-এমপি, পুলিশপ্রধান, প্রশাসনের সচিব অকল্পনীয় সম্পদের মালিক হয়েছেন। শেখ হাসিনার ওই সংবাদ সম্মেলনের কয়েক মাস আগে সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের তুলনাহীন দুর্নীতির খবর লিড স্টোরি হয়।

পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা আবার শুদ্ধাচার পদক বিজয়ী। বেনজীর ও তার স্ত্রীর দুর্নীতির খবরের পর ক্রমাগতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দুর্নীতির বিবরণ।

ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামাল ও তার স্ত্রীর দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে এবং পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন।সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নামে বিদেশে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য ফাঁস করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ২০ জন প্রার্থীর যারা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন গত পাঁচ বছরে নজিরবিহীন ভাবে সম্পদ বেড়েছে।টিআইবি গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে জানায় শতকোটি টাকার বেশি অস্থাবর সম্পদ রয়েছে ১৮ প্রার্থীর।

শুধু সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ নন, পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের শত শত টাকার দুর্নীতির খবর গত মার্চ মাসে সংবাদপত্রের প্রধান শিরোনাম হয়েছে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা রাজধানীর গুলশানে চারটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, শতশত বিঘা জমি, রিসোর্টের মালিক। ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ, গাজীপুর থেকে টেকনাফ, কোথায় নেই তার সম্পদ।

বেনজীরের স্ত্রী গৃহিণী থেকে রাতারাতি ব্যবসায়ী বনে যাওয়া জিসান মির্জার সম্পদও স্বামীর চেয়ে কম নয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে তার নামে ২৪০ বিঘা জমি, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ এবং বিভিন্ন কোম্পানির মালিকানার তথ্য খবরে প্রকাশিত হয়েছে।

বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশিদ। রাজধানীর উত্তরা, গাজীপুর, আশুলিয়া ও কক্সবাজারের টেকনাফে হারুনের অঢেল সম্পদ রয়েছে মর্মে সংবাদপত্রে  খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই পুলিশ কর্মকর্তা শুধু বিরোধী দলের নেতাদের রিমান্ডে নেওয়ার নাম করে নির্যাতন করেননি, অসংখ্য ব্যবসায়ীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করতেন।

এমন অসংখ্য অভিযোগ পুলিশের আরেক সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার এম শিবলী নোমানের দুর্নীতির খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। খবরে নোমানের শত শত বিঘা জমি, এগ্রো ফার্ম, গাড়ির শোরুম, একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

গত ১৫ বছর যে লাগাম ছাড়া দুর্নীতি হয়েছে আগের কোনো সরকারের আমলে এর ধারেকাছেও তা হয়নি। বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রীর বাসার কাজের লোক ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ করেছে, এমনটি আর কখনোই দেখা যায়নি।

প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে শেখ হাসিনা তার এই ‘কীর্তিমান’ কাজের লোকটির কার্ড ‘সিজ’ করে বের করে দিয়েছেন, ৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতির এটুকুই ছিল শাস্তি। সরকারের বিরাট সংখ্যক কর্মকর্তা, মন্ত্রী, এমপির বেপরোয়া দুর্নীতি সামাল দিতে না পেরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলতে শুরু করেন, দুর্নীতি হচ্ছে ‘ওয়ে অব লাইফ’।

০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ দৈনিক ইত্তেফাকে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। যেখানে, বলা হয়,শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিকের মালয়েশিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র (আরএনপিপি) থেকে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা) লোপাটের অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা রাশিয়ান রোসাটমের কাছ থেকে সোভিয়েত আমলের পারমাণবিক চুল্লি কিনতে ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেন। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ ব্যয় ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।

মালয়েশিয়ার ব্যাংকে রক্ষিত বিভিন্ন রাশিয়ান স্ল্যাশ ফান্ড থেকে এই ৫ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন ব্যাংকে স্থানান্তরে শেখ হাসিনাকে সহায়তা করেছিল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাটম। যাতে মধ্যস্ততা করেন সজিব ওয়াজেদ জয় ও ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক।

দেশের সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল প্রকল্প রূপপুরের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। আশা করা হচ্ছে, এটি পুরোপুরি বাস্তবায়নের পর দেশের ২০ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করবে। স

রাশিয়ার সহযোগিতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণে খরচ ধরা হয় ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার। প্রয়োজনের তুলনায় যা অনেক বেশি। মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এই বাজেট থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের সুযোগ করে দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা-রোসাটম।

নিজের ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের মধ্যস্থতায় রাশিয়ার সঙ্গে এ চুক্তি করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এ মধ্যস্থতার বিনিময়ে পাচার করা অর্থের ৩০ শতাংশ পেয়েছেন টিউলিপ, শেখ রেহানা ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য।

অর্থপাচার,দুর্নীতি,শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারী এগুলা সবই শেখ হাসিনা প্রত্যক্ষ ভূমিকায় হয়েছে,যেগুলো সবি জনগণ দেখছেন চৌর্যবৃত্তি হিসাবে।

অন্যদিকে বিগত সরকারের আমলে,গুম.খুন,হত্যা,বিরোধীদলকে দমন নীপিড়ন,মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া যার সবই রাষ্ট্রকে ব্যাবহার করে মাফিয়া কর্মকান্ডেরই অংশ মনে করছেন মানুষ।

ফুয়াদ

×