উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল
অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। এ জন্য বুধবার (আজ) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে বলেও জানান তিনি।
আইন উপদেষ্টা আরও বলেন, অংশীজনদের সঙ্গে বড় পরিসরে সভা করে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে নতুন আইন হচ্ছে। পরবর্তী সকল বিচারক নিয়োগ নতুন হতে যাওয়া আইনের আওতায় হবে। মঙ্গলবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: আইন মন্ত্রণালয়ের কৈফিয়ত’ শিরোনামে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা জানান। এই ১০০ দিন তার মন্ত্রণালয়ে কী কী কাজ হয়েছে, সেসবের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন ড. আসিফ নজরুল।
আইন উপদেষ্টা বলেন, হয়রানিমূলক মামলা নিয়ে সরকার বিব্রত। ‘হয়রানিমূলক মামলা নিয়ে নানান রকম প্রতিকার ব্যবস্থার কথা চিন্তা করেছি। একবার সিদ্ধান্ত নিলাম সিআরপিসি পরিবর্তন করে পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া হোক, উনারা এফআইআর করার আগে তদন্ত করবেন। তখন বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলা হলো, এটা করা হলে পুলিশকে দুবার স্বেচ্ছাচারিতা করার সুযোগ দেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, যদি পুলিশ হয়রানি করে। এখন যেটা চিন্তা করছি এসপি, ডিসি, জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তাদের নিয়ে কোনো কমিটি করা যায় কি না। এফআইআর করার আগে এই কমিটি যাচাই-বাছাই করে দেবে। এটা আমাদের করতে হবে, কারণ যারা হয়রানিমূলক ও মিথ্যা মামলা করছেন, বাণিজ্যমূলক মামলা করছেন। কাউকে কাউকে নাকি হুমকিও দেওয়া হচ্ছে টাকা না দিলে মামলা করবেন। আপনারা শুধু মনে রাখবেন, আমি যদি এই মন্ত্রণালয়ে থাকি আপনাদের (মিথ্যা মামলা করা ব্যক্তি) কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায় সেটার আইন আমি খুঁজে বের করব।’
বিভিন্ন পক্ষের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে কী উদ্যোগ আছে- জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ‘রাস্তা ব্লক করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অসহনীয় জ্যাম সৃষ্টি করে আন্দোলন করলে, আমি মনে করি সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে পারেন না। কালকে আমি শুনেছি ট্রেনে ইট ছুড়ে সাধারণ মানুষকে আহত করা হয়েছে। এটা কী ধরনের আন্দোলন?’
তিনি বলেন, রাষ্ট্র যদি শক্ত হয়, দুয়েকজন যদি আহত হয়, গ্রেপ্তার হয়- এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের কষ্ট তৈরি করবে না? আপনারা আবার দমন-নিপীড়নের মধ্যে যাচ্ছেন, এটা তো আমাদের মাথায় রাখতে হয়। শক্ত যখন হব, ভালোভাবে হব।
ড. আসিফ নজরুল জানান, সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ বাতিলক্রমে কম্পিউটার সম্পর্কিত অপরাধগুলো প্রতিরোধের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪’ প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা আইন রহিত হলে উক্ত আইনের অধীনে দায়েরকৃত সব স্পিচ-ওফেন্সের মামলা প্রত্যাহার করা হবে উল্লেখ করে ড. আসিফ নজরুল বলেন, অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করে এই আইন প্রত্যাহারে আমরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করেছি। তবে হ্যাকিং বা কম্পিউটার অপরাধ সংক্রান্ত মামলাগুলো চলমান থাকবে বলেও জানান তিনি।
আইন উপদেষ্টা জানান, এই কদিনে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে পাঁচজন বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগে ২৩ জন বিচারপতি এবং অধস্তন আদালতে ১০৯ জন বিচারক নিয়োগে সাচিবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ৬১টি জেলায় চার হাজার ৩০০ জন আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দ্রুততম সময়ে সব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, এত বেশিসংখ্যক নিয়োগ বাংলাদেশে এর আগে ঘটেনি। এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, যারা ‘মামলা বাণিজ্য’ করছে, তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি) বিস্ফোরক মামলা পরিচালনার জন্য ২০ জন স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনে সহায়তা করেছে আইন মন্ত্রণালয়। চিফ প্রসিকিউটরসহ ১১ জন প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তাছাড়া অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে ২৩৯ জন আইন কর্মকর্তা তথা সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে এবং গত জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক মানদ- নিশ্চিতের লক্ষ্যে রোম স্ট্যাটিউট এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সুপারিশের আলোকে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ এর সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান আইন উপদেষ্টা। এই আইন সংশোধনী অধ্যাদেশ বুধবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তোলা হবে বলেও জানান তিনি। অধ্যাদেশটি পাস হলে সে অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানান তিনি।
আইন উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ আইনের খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি, নতুন আইনের মাধ্যমেই পরবর্তী বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, অধস্তন আদালতের বিচারক, রেজিস্ট্রেশন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং আইন মন্ত্রণালয় ও এর অধীন দপ্তর সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব সংগ্রহ করা হয়েছে। এই হিসাব বিবরণী এখন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন অধ্যাদেশ হচ্ছে, সেখানে কোনো রাজনৈতিক দলের বিচারের ধারা যুক্ত হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, ‘একটা-দুটো দিন অপেক্ষা করেন। আর সংশোধনীটা তো উপদেষ্টা পরিষদকে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের প্রস্তাবনায় যেটা আছে, সেখানে আদালতকে সরাসরি ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তবে আদালত যদি মনে করেন, তাহলে তারা এ বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে কনসার্ন অথরিটির কাছে সুপারিশ করতে পারেন।’
লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের মাধ্যমে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ এবং জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪ সহ মোট ১০টি অধ্যাদেশ প্রণয়নে ভেটিং সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৯৫টি প্রজ্ঞাপন, ৩৩টি বৈদেশিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক ভেটিং করা হয়েছে। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ অনুসমর্থনে আইন মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান ও গুমে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের নিমিত্ত তদন্ত কমিশন গঠনে আইন ও বিচার বিভাগ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়েছে। এই কমিশনকেও আইন মন্ত্রণালয় সাচিবিক সহায়তাও দিয়ে যাচ্ছে।
তাছাড়া স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই সংস্কার কমিশন গত ১২ নভেম্বর আমার সঙ্গে বৈঠক করেছে। আশা করছি, কমিশন বিচার বিভাগের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রস্তাব দ্রুতই প্রস্তুত করবে। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজ করছেন, সেখানে কিছু ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে কিন্তু চেষ্টার ঘাটতি নেই উল্লেখ করে ড. আসিফ নজরুল বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন সংস্কার কমিশন ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন গঠনে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হয়েছে এবং সংস্কার কমিশনগুলোকে সকল প্রকারের সাচিবিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করা হবে বলেও জানান আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘সরকার ভালো একটা নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে অনেক উপদেষ্টা আগের পেশায় ফিরে যেতে চায়।’
এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, দেশে কোনো আসামিকে না পেলে রেড এলার্ট জারির আবেদন করতেই পারি। বাংলাদেশ ইন্টারপোলের সদস্য। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের ফেলে রেখে নিজে পালিয়েছেন। নিজে পালানোর তিনদিন আগে তার স্বজনদের বিদেশে পাঠিয়েছেন। নেতাকর্মীদের তাকে প্রশ্ন করা উচিত, তাদের ফেলে রেখে কেন পালিয়েছেন তিনি?’
আরেক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, সরকার আওয়ামী লীগের মতো দমন-পীড়ন চায় না। অযৌক্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে নানা দুর্ভোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকার বিষয়গুলো দেখছে। কঠোর হলে সরকার ভালোভাবেই কঠোর হবে।