অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে নিজের খারাপ লাগার কথা জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমরা মানুষকে ধৈর্য ধরতে বলি। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে ধৈর্য ধরা কঠিন।
তিনি বলেন, এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলে অল্প কিছু বাজার করা যায়। আমিও সেটা টের পাই, আপনারা সবাই টের পান। আমিও তো বাজারে যাই, আমারও দুঃখ লাগে। সাধারণ মানুষের জ্বালা আছে, তারা সেটা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেন।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি একদিনে হয়নি। মূল্যস্ফীতি কমপ্লেক্স ফ্যাক্টর (জটিল বিষয়)। আগে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছেন। তারপর পাবলিক সেক্টরে বড় বড় প্রজেক্টে খরচ করেছেন, ওটার আউটপুট তো আসে না। পদ্মা ব্রিজের যাত্রা শুরু হয়েছে, এটির সুফল দক্ষিণবঙ্গ পাঁচ বছর পর পাবে।
তিনি বলেন, আমাদের সাপ্লাই চেইনটা এখন ঠিক রাখতে হবে। আমরা এনবিআর থেকে পেঁয়াজের শুল্ক কমিয়ে দিয়েছি। আলুর শুল্ক কম। চিনির শুল্ক কমানো হয়েছে। কয়েকদিন আগে চালের শুল্কও কমানো হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমরা সার, চাল, ডাল, সয়াবিন তেল, রোজার খেজুরের নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করেছি। এসবের জন্য এলসি মার্জিন জিরো (শূন্য) করে দিয়েছি।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি আমাদের পীড়া দেয়। আরেকটা সমস্যা জ্বালানির দাম। আপনারাও জানেন আদানির (ভারতীয় কোম্পানি) একটা দাবি ছিল ৭০০ মিলিয়নের। আদানিকে ২০০ মিলিয়ন দেওয়া হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের পাওনা বকেয়া ছিল, ওরা বলেছে সার দেওয়া বন্ধ করে দেবে। বকেয়া পরিশোধ করার পর এখন সার দিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্রায় ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ছিল বকেয়া পাওনা। এটিকে কমিয়ে এনেছি। এখন ৪০০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পাওনা আছে। এক টাকাও রিজার্ভ থেকে খরচ করা হয়নি। আগে রিজার্ভ ছিল ৪২ বিলিয়ন ডলার, হুট করে ১২ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। আর্টিফিসিয়ালি রিজার্ভ দেখানোর চেষ্টা করা হয়। এগুলো অকল্পনীয় বিষয়।
ব্যাংক ও বিমা খাতের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেকগুলো বিমা কোম্পানি আছে গ্রাহককে প্রিমিয়ামের টাকা দেয়, টাকা আত্মসাৎ করে। জীবন বিমা, সাধারণ বিমার সমস্যা আছে। এগুলো আমরা জানি। কিন্তু সমস্যাগুলো এতো ব্যাপক, চট করে সমাধান করা যাবে না।
বন্ধ হবে না কোনো ব্যাংক ॥ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ব্যাংক খাতের যেসব খারাপ সিনড্রোম ছিল সেগুলো কারেকশন হচ্ছে। কিছু ব্যাংক দুরবস্থা কাটিয়ে ফিরে আসছে। ইসলামী ব্যাংক বড় ব্যাংক, এটি দুর্বলতা কাটিয়ে ভালোর দিকে যাচ্ছে। কিছু ব্যাংক খুঁড়িয়ে চলবে, তবে কোনো ব্যাংক বন্ধ করার ইচ্ছা সরকারের নেই। এটি আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করছি। আমানতকারীদের সুরক্ষা দেওয়া হবে। ব্যাংক খাতে হারানো আস্থা ফেরানো আমাদের অন্যতম লক্ষ্য।
তিনি বলেন, কিছু ব্যাংক ফিরে আসছে। ইসলামী ব্যাংক বিগেস্ট ব্যাংক। এটি ভালোর দিকে যাচ্ছে। আমরা কোনো ব্যাংক বন্ধ করব না।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ভালো ব্যবসায়ীদের ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা ঋণ নিয়ে ঠিকমতো ফেরত দেন এবং ঠিকমতো কর দেন, তাদের কোনো সমস্যা হবে না। তারাই ভীত, যারা বিগত সরকারের সময়ে নানাভাবে অনেককিছু করেছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারক এ প্রসঙ্গে বলেন, যেসব দুর্বল ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, তারা যেন আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারে সেজন্য খুব দ্রুত উদ্যোগ দেখা যাবে।
চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের আর্থিক খাত ॥ দেশের আর্থিক খাত ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ ও প্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে সরকার। তবে অত্যাবশ্যকীয় ছাড়া সবধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। সবধরনের গাড়ি কেনা বন্ধ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে রাজস্ব বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ। এটা করা না গেলে উন্নয়নমূলক কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হবে।
বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব পুনরায় খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান অর্থ উপদেষ্টা। এ সময় ব্যাংকিং খাত প্রসঙ্গেও কথা বলেন সাবেক এই গভর্নর। তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে আইন অমান্য করাই ছিল ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখভালেরও ঘাটতি ছিল। যে কারণে ব্যাংকিং খাতের এই দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে কিছু দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। তবে কোনোভাবেই কোনো ব্যাংক বন্ধ করা হবে না।
কমবে বাজেট ব্যয় ॥ বাজেটের ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) কোন কোন প্রকল্প অপ্রয়োজনীয় এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বাজেটের ব্যয় কমানো হবে। তবে সরকারি কর্মকর্তা যারা আছেন তাদের বেতন-ভাতা আটকাবে না। তিনি বলেন, আমাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) সাফল্যের সূর্য উদয় হয়েছে এবং আমাদের অর্জন খুব একটা খারাপ নয়। আমরা একটি পায়ের ছাপ রেখে যাব। আমরা এমন জায়গাগুলো দিয়ে হাঁটব যেখানে রাস্তা তৈরির দিক নির্দেশ করবে। আমরা কিছু সংস্কার করে যাব। পরবর্তীকালে যারা আসবেন তারা বুঝবেন যে এখান থেকে রাস্তা তৈরি করতে হবে। একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
মিলবে ১১০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ ॥ অর্থ সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬০০ মিলিয়ন ডলার এবং বিশ্বব্যাংক ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দেবে বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার যেসব পলিসি নিচ্ছে, এগুলোর ব্যাপারে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক ব্যাপক সমাধান দিয়েছে। আমাদের প্রকৃত যে প্ল্যান ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আমরা পাচ্ছি।
অর্থ সচিব বলেন, এরই মধ্যে এডিবির সঙ্গে ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণের নেগোসিয়েশন হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে এই অর্থ আমরা পাব। বিশ্বব্যাংকের ৫০০ মিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ নেগোসিয়েশন হয়ে গেছে। এটিও ডিসেম্বরের মধ্যে পাব। এ দুইটি ঋণের প্রকৃত অঙ্ক ছিল ৩০০ ও ২৫০ মিলিয়ন ডলার। তার মানে দুইটিই আমরা ডাবল করে পাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য আইএমএফের কাছে অতিরিক্ত সহায়তা চেয়েছি। এরমধ্যে এই বছরে আমরা অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন ডলার চেয়েছি। আগামী ৪ ডিসেম্বর আইএমএফ (প্রতিনিধিদল) আসবে এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত হবে। যে প্রগ্রেস দেখছি, আমরা আশাবাদী এটি আমরা পাব।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকি বলেন, এডিবির কাছ থেকে ৬০০ মিলিয়ন, বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছে। ডিসেম্বরে সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদল আসবে। তারপরই সিদ্ধান্ত।
খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালত সক্রিয় হবে ॥ খেলাপি ঋণ আদায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হবে কি না- সাংবাদিকদের করা এমন প্রশ্নে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালত আরও সক্রিয় করা হবে। তবে গভর্নরকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া ঠিক হবে না।
একইসঙ্গে, হাইকোর্টে হওয়া রিট মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতেও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, হাইকোর্টের রিট মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য দুইটি বেঞ্চ রয়েছে। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল ও গভর্নরের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে, যেন এই বেঞ্চগুলো আগামী তিন মাস শুধু রিট মামলাগুলো পরিচালনা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান প্রমুখ।