ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

মশা নিধনে সাধারণ মানুষকে সচেতন হওয়ার তাগিদ

ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে ॥ বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্ত

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে ॥ বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্ত

.

দিন যত যাচ্ছে ততই জটিল আকার ধারণ করছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। বছর শেষ হতে চললেও প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর ভিড়। শুধু নভেম্বরের ১৮ দিনেই মৃত্যু হয়েছে ১০৬ জনের। আক্রান্ত হয়েছেন ১৯ হাজারের বেশি। বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার ৬৮ জনে। মোট মৃত্যু হয়েছে ৪২৬ জন। এমন পরিস্থিতিতে মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মূলত: এবার সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই দেশজুড়ে বাড়তে থাকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে মৃত্যুও। অক্টোবরে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে সংক্রমণ আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু নভেম্বরে বৃষ্টি না থাকলেও বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বাসা-বাড়িতে জমে থাকা পানিকে দূষছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এক্ষেত্রে শুধু সরকারিভাবে মশা নিধনে তৎপরতা হলেই চলবে না বরং প্রত্যেকের নিজের বাড়ি ঘর পরিচ্ছন্ন রাখার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নভেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ১০৬ জনের। একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছে ১৯ হাজারের ওপরে। হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে রোগী। এ মাসে একদিনে সর্বোচ্চ ১৩শ’ ৮৯ জন রোগীর আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে গত রবিবার।
যদিও সিটি করপোরেশনগুলো বলছে, এডিসের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রাজধানীজুড়ে মশা নিধনে নেওয়া হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা। কিন্তু কার্যত তা চোখে পড়ছে না। উত্তর সিটির কিছু এলাকায় মশা নিধনে চিরুনি অভিযান চললেও দক্ষিণ সিটিতে নেই তার বালাই। উত্তর সিটি কর্পোরেশন বলছে, মশা নিধনে কর্পোরেশনের প্রায় ৩ হাজার কর্মী কাজ করছেন। বিপরীতে ঘনবসতিপূর্ণ দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে নেই তেমন তৎপরতা।
ফলে ওই এলাকার আওতাধীন মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড় বাড়ছে প্রতিদিনই। তাদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে জানিয়ে হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ডেঙ্গুর একটা নির্দিষ্ট মৌসুম থাকে। চিকিৎসকরা সেই হিসেবেই চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। কিন্তু চলতি বছর যেন সব হিসাব ছাড়িয়ে গেছে। নভেম্বর শেষ হতে চললেও প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। অনেকে হাসপাতালে সিট না পেয়ে মেঝেতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সম্প্রতি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বেশি হচ্ছে কেন জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, গত কয়েক বছর আমরা সাধারণ ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গু ছাড়াও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখেছি, এক্সপান্ডেড  ডেঙ্গু  দেখেছি। তবে এ বছর ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গুর পরিমাণটাই বেশি ছিল এতদিন। বেশিরভাগেরই জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা- এ ধরনের লক্ষণ বেশি ছিল। আগের বছর যেমনটা হয়েছে হঠাৎ করে প্রেশার  লো হয়ে যাওয়া, রক্তক্ষরণ এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছিল এ বছর তেমনটি দেখা যায়নি। তবে গত কয়েকদিন যাবত তা দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হতে পারে হয়তো রোগীরা ডেঙ্গুকে মৌসুমি জ্বর হিসেবে বিবেচনা করে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন না। যখন যাচ্ছেন তখন চিকিৎসকের আর করার কিছুই থাকছে না। এমন বহু রোগী আমাদের কাছে আসছে যারা কয়েকদিনের জ্বরে ভুগে কাহিল হয়ে রয়েছেন। কারও কারও আবার মাল্টি অর্গান ফেইল করছে। তাই আমরা বলছি জ্বর হলেই সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে। ডেঙ্গু হোক বা না হোক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই চিকিৎসা চালাতে হবে। নইলে বিপদ।
প্রতিবছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গত বছর দেশে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন  ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নেন দুই লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। ওই বছর আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন তিন লাখ ১৮ হাজার ৭৪৯ জন। গত বছর এক হাজার ৭০৫ জন মশাবাহিত এ রোগে মারা যান, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু।
এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
চলতি বছর এই রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া পরিস্থিতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। করোনার সময় যেভাবে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষেরও সংশ্লিষ্টতা ছিল ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে তা একেবারে নেই। মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পিপিই, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইনের মতো  কঠিন শব্দ ছাড়া শুধুমাত্র মশা নিধন করেই যে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাতেও যেন সায় নেই কারও। এতে করে দিনের পর দিন করুণ মৃত্যুবরণ করে নিতে হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের। তাই আমাদের নিজেদেরই এখন সচেতন হতে হবে। আর কোনো বিকল্প আপাতত নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার আওতাধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে এক জরিপে গত ১৭ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত চালানো প্রাক-বর্ষা জরিপে বলা হয়, ওই জরিপে রাজধানীর প্রায় ১৫ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল। ওইসময় ঢাকা উত্তরের ১৪.৩০ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণের ১৪.৯৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে।
বছর শেষেও পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি উল্লেখ করে কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার জনকণ্ঠকে বলেন, বৃষ্টি কমলেও বাসা-বাড়িতে জমানো পানি থাকছেই। ফলে মশা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মশা নিধন কার্যক্রমেও কিছুটা স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। ফলে এডিস মশার প্রজনন বাড়ছে।
করোনার সময়টায় উন্নত বিশ্বের পরিস্থিতি দেখে জনগণের মধ্যে একটা আতংক তৈরি হয়েছিল। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে যা হচ্ছে না। ডেঙ্গু বাংলাদেশেই তীব্রতা চালাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরও কিছু কিছু জায়গায় ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। কিন্তু তারা নিয়ন্ত্রণে তৎপর। যে তৎপরতটা প্রয়োজন ছিল আমাদের। করোনার সময় যেমন একটা গাইড লাইন, কারিগরি কমিটি তৈরি করে দেয়া হয়েছিল তেমনি এখনো তার প্রয়োজন ছিল। যেহেতু এর চিকিৎসা নেই তাই প্রতিরোধই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষ যদি না বুঝে যে মশার কামড়ে তার মৃত্যু হতে পারে। তাহলে কে বোঝাবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয় মূলত বর্ষাকালে। আগস্ট থেকে বাড়তে থাকে এর ভয়াবহতা। কিন্তু চলতি বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি শুরু হয়। এতে করে এডিস মশারা তাদের প্রজননে উপযুক্ত আবহাওয়া পেয়ে গেছে বর্ষার আগেই। এখনো এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে ডেঙ্গুর প্রজননস্থল ধ্বংসে ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন তারা। একই সঙ্গে আবহাওয়ার তারতম্যও সমানভাবে দায়ী উল্লেখ করে তারা বলছেন, এডিসের জীবাণুবাহী মশার প্রজননস্থল ধ্বংস না করতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে মশার উৎপাত আরও বেড়েছে বলে দাবি করেছেন নগরের বাসিন্দারা। ঢাকার উত্তর সিটির অধীনে উত্তরা ৮ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা মফিজুল হক বলেন, শীত শীত আবহাওয়া পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মশার উৎপাতও। কোনটা এডিস মশা আর কোনটা এডিস না সেটা তো বোঝার উপায় নেই। সিটি কর্পোরেশন থেকেও মশা মারার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। এক্ষেত্রে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আতঙ্কিতই থাকতে হয়।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের গোড়ান এলাকার বাসিন্দা ফুল আক্তার নিজের ডেঙ্গু আক্রান্ত স্বামীর চিকিৎসা করাতে এসেছেন রাজধানীর ডিএনসিসির কোভিড হাসপাতালে। মশা নিধনে তার এলাকায় কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় না অভিযোগ করে বলেন, আমার স্বামী এই নিয়ে দুই বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এলাকার ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনগুলো যেন নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। মশা মারতে কোনোদিনই তাদের দেখা যায় না।
তবে সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে নিয়মিত মশার প্রজননস্থল ধ্বংস ও লার্ভিসাইড স্প্রে করছেন মশককর্মীরা। চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় মশক নিধন অভিযান বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছেন ৩ হাজার ২১৪ মশককর্মী। শুধু রাজধানী নয় স্থানীয় সরকার বিভাগের সব সিটি করপোরেশন এবং ঝুঁকিপূর্ণ পৌরসভায়ও কাজ করছেন এসব মশককর্মী।
স্থানীয় সরকার বিভাগ এ বিষয়ে জানায়, চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার বিভাগের এক জরুরি সভায় ১০টি টিম গঠন করা হয়। যারা ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সাভার, দোহার, তারাবো, রূপগঞ্জ ও অন্যান্য পৌরসভায় মশক নিধন অভিযান কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সমন্বয় ও নিবিড় তদারকি করছে।
তাদের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, সারাদেশে সম্প্রতি ১৮ হাজার ৬১১টি স্থান পরিদর্শন করা হয়েছে। পরিদর্শন করা স্থানগুলোর মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় ৬৮২টি এবং ৭৭টি  পৌরসভায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৯ হাজার ৩৬৫টি স্থানে মশার প্রজননস্থল ধ্বংস ও লার্ভিসাইড স্প্রে করা হয়েছে। ড্রাম, ভাঙা পাত্র, নির্মাণাধীন ভবন, ফুলের টব ও লিফটের গর্তে জমে থাকা পানি পাওয়ার কারণে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৪১টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫টি সতর্কীকরণ নোটিস জারি করা হয়।
এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং, লিফলেট ও পোস্টার বিতরণ করা হচ্ছে নিয়মিত।

×