ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি

রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জন হবে না

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:১৪, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জন হবে না

.

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিকাশ ও প্রভাব দৃশ্যমান। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের কারণে জেন্ডার, ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। যা বৈষম্যবিরোধী চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। 
এ সময় টিআইবি প্রধান নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপসহ আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ সৃষ্টি না করে চট করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন হবে না। রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে আন্দোলনের উদ্দেশ্যও ব্যাহত হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন, মূল্যায়ন করে সংস্থাটির প্রতিবেদন বলছে, কোনো কোনো মহলের অতিক্ষমতায়ন ও তার অপব্যবহার এবং চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। যা অসাম্প্রদায়িক সম-অধিকারভিত্তিক ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের অন্তরায়।
সোমবার ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ’: কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী ১০০ দিনের ওপর টিআইবির পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সংস্থাটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আলোচ্য সময়ে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা ও ৮টি জাতীয় দিবস পালন না করার সিদ্ধান্ত সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়োগ অব্যাহত রয়েছে। জুলাই-আগস্টে গণহত্যায় জড়িতদের বিচার শুরু হয়েছে, তবে হতাহতদের সংখ্যা নিয়ে তারতম্য দেখা গেছে।
এছাড়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কারাগার থেকে মুক্তির প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিচার বিভাগকে দুর্নীতি ও দলীয় প্রভাবমুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সাবেক সরকারের সময় দায়ের করা মামলা ও রায় থেকে অব্যাহতি এবং দ- মওকুফের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নতুন বাংলাদেশে দুটি বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। তার একটি হলো রাষ্ট্র সংস্কার, আরেকটি হলো নতুন রাজনৈতিক সামাজিক সমঝোতা। এই লক্ষ্যগুলোকে সামনে রেখেই অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। সরকারের কাজ কোথায় কী হচ্ছে, সেইগুলো চিহ্নিত করাও আমাদের দায়িত্ব।
চট করে নির্বাচন হলে লক্ষ্য অর্জন হবে না ॥ সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশনের প্রধান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপসহ আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ সৃষ্টি না করে চট করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন হবে না। রাষ্ট্র সংস্কারের আগে নির্বাচন হলে আন্দোলনের উদ্দেশ্যও ব্যাহত হবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের সময়সীমাকে কেন্দ্র করে কিছু অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। এ নিয়ে জবাব দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সংস্কার কমিশনের মেয়াদ ও নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, শুধু সরকার পরিবর্তনের জন্য ছাত্র-জনতার আন্দোলন হয়নি। আন্দোলন হয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য। নতুন বাংলাদেশ ও রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করেছে তা রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ। এসব কমিশন প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদনের ওপর বাস্তব সংস্কার সম্পূর্ণ করতে হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারকেই বলতে হবে, নির্বাচনের জন্য কতটুকু সময় লাগবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, যাদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে অস্থিরতা আছে, যারা নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করছেন, সরকারের উচিত এসব বিষয়ে উত্তর দেওয়া।
১০০ দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত ইতিবাচক ও রাষ্ট্র সংস্কারে উপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের ওপর বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে যে কর্তৃত্ব বা ম্যান্ডেট আছে তার তুলনায় যে কাজ হয়েছে তা কোনো অংশে কম নয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, পুলিশের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হওয়ার কারণে সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। পুলিশে জনবলের ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিকূলতা আছে। এসব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, যতটুকু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল, ততটুকু হয়নি। কিন্তু সেটি নিয়ে শঙ্কা বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক দিক হলো- জুলাই-আগস্টে হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়া। এছাড়া হতাহতদের ক্ষতিপূরণ, গণভবনকে জাদুঘর করা, আর্থিক খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে বাজার ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যায়নি। এছাড়া শিক্ষা খাতেও সংস্কার প্রয়োজন।     
বাস্তবতা মেনে নিতে ভারত ব্যর্থ হয়েছে ॥ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকার পতনের বাস্তবতা মেনে নিতে ভারতের সরকার, রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যম ব্যর্থ হয়েছে।  
রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কড়া প্রতিবাদ সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা চলমান। শেখ হাসিনাসহ কয়েকজন রাজনীতিবিদ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। গণঅভ্যুত্থানে বহির্শক্তির ভূমিকা ও কর্তৃত্ববাদী সরকারের (আওয়ামী লীগের) পক্ষের বয়ান প্রচার অব্যাহত রেখেছে ভারত। এছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ, ভারতীয় গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ সংক্রান্ত উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তারা এখনো কর্তৃত্ববাদীর সমর্থনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বাংলাদেশকে দেখছে। ভারত সম্পর্কে মানুষের যে লিবারেল ধারণা ছিল, সেই ভারত কিন্তু পরিবর্তিত বলে আমরা মনে করি। এমনকি ভারতীয় গণমাধ্যমেও বাংলাদেশ সম্পর্কে যেভাবে বলা হচ্ছে, সেটি বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিব্রতকর। ভারতের জন্যও এটি বিব্রতকর ও লজ্জাজনক। ভারত তার অবস্থান থেকে সরে আসবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা বা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া বিতর্কিত। আটটি জাতীয় দিবস পালন না করার সিদ্ধান্ত সমালোচিত। নিষিদ্ধ ঘোষণা সত্ত্বেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম চলমান।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ, হামলা-মামলাসহ একাধিক গণমাধ্যম বন্ধ করার তৎপরতা রয়েছে, যা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হুমকি। সরকারের দোসর ও আন্দোলনের বিরোধিতা করার অভিযোগে ঢালাওভাবে সাংবাদিকদের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে।
গণহত্যায় জড়িতদের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় জড়িতদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা করা হয়েছে। মামলায় ঢালাওভাবে আসামি হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ, পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা, চাঁদাবাজি ও হয়রানি করতে অনেককে আসামি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া চাপের মুখে তদন্ত না করে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন জনের গ্রেপ্তার নিয়ে লুকোচুরি- একাধিকবার একেক জায়গা থেকে গ্রেপ্ততারের সংবাদ পাওয়া গেছে।
আরও বলা হয়েছে, আইনি প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের পুরনো ধারা বিদ্যমান রয়েছে। গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আদালতে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। সাবেক বিচারপতির ওপর আক্রমণ, আসামিপক্ষের আইনজীবীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন না করে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও কৌঁসুলিদের নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে। তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রধান গবেষক শাহজাদা এম আকরাম। সংবাদ সম্মেলনে সূচনা বক্তব্য রাখেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। প্রতিবেদন তৈরিতে আরও যুক্ত ছিলেন মো. জুলকারনাইন, ফারহানা রহমান ও মো. মোস্তফা কামাল।

×