.
দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার প্রথম ১০০ দিনে অর্থাৎ তিন মাসের বেশি সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, কোস্ট গার্ড ও র্যাবের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান অব্যাহত আছে।
পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে দেশে পাঁচ শতাধিক মানুষ খুন হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক সহস্রাধিক। গণপিটুনিতে মারা পড়েছে অন্তত ৬৮ জন। এ সময় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭৮টি। আদালত প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন স্থানে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনি দিয়ে বিচার-বহির্ভূত হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে।
রাজধানীর আজিমপুরে ডাকাত দল টাকা ও স্বর্ণালঙ্কারের পাশাপাশি একটি দুধের শিশুকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে উদ্ধার করা হয়। রাজধানী ঢাকায় তিন ঘণ্টার ব্যবধানে ধানমন্ডিতে ডাকাত দলের ছুরিকাঘাতে নামাজরত অবস্থায় খুন হয়েছেন চিকিৎসক, হাজারীবাগে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছে কিশোর। গত চব্বিশ ঘণ্টার ব্যাবধানে ঢাকার বাইরে খুন হয়েছেন নোয়াখালীতে যুবদল নেতা, ঘাটাইলে যুবক, নড়াইলে শিশু, শেরপুর, গফরগাঁওয়ে তিনজন। নারায়ণগঞ্জে একদিনের ব্যবধানে অন্তত পাঁচজন খুন হয়েছেন।
সিলেটে পাঁচ বছরের শিশু মনতাহার নির্মম হত্যাকা-ের ঘটনায় তার গৃহশিক্ষক জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানী ঢাকার মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে। সেখানে বিহারি ক্যাম্পে খুনাখুনি, প্রকাশ্যে ছিনতাই, ডাকাতি, সশস্ত্র মহড়ার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি উন্নতির জন্য মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযান হয়েছে। জেনেভা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক সন্দেহভাজন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু এখনো মানুষের আতঙ্ক কাটেনি বলেই জানান এলাকাবাসী।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুনের পাশাপাশি মানুষের প্রতি নির্মম অপরাধপ্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে। প্রেমিককে খুন করে টুকরা টুকরা করছে প্রেমিকা। মাকে খুন করছে সন্তান, স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, আবার স্বামীর হাতে স্ত্রী, নিষ্পাপ শিশুসন্তানকে ছুড়ে মারা হচ্ছে রাস্তায়। খুনের পর লাশ রাখা হচ্ছে শয়নকক্ষে। ডাস্টবিনে, পানির ট্যাঙ্কে কিংবা ড্রেনে মিলছে লাশ। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। পারিবারক বিরোধ ও মাদকের অর্থ জোগাড় এবং হতাশা, ইন্টারনেটের অপব্যবহার. অসহিষ্ণুতা, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতা। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, গত ৫ অক্টোবর সরকার পতনের পর থেকে দেশে সামাজিক সহিংসতার ঘটনা বেড়েই চলেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে সারাদেশে অন্তত পাঁচ শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত চব্বিশ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৯ জন খুন হয়েছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে প্রায় প্রতিদিনই সামাজিক নানা কারণে হত্যার ঘটনা ঘটছে। নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত গৃহকোণও অনিরাপদ। সেখানেও হামলা চালিয়ে হত্যা করা হচ্ছে মানুষ। এসব ঘটনায় মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারাও রেহাই পাচ্ছেন না। কিছু ক্ষেত্রে বলি হচ্ছে নারী ও শিশুরা। মানুষ আগের চেয়ে বর্তমানে অনেক সহিংস হয়ে উঠেছে। এসব ঘটনায় পুলিশও রেহাই পাচ্ছে না। সড়কে ছোট ছোট বিরোধে প্রায়ই সহিংসতার অভিযোগ পাচ্ছে তারা। আর মাঠ পর্যায়ে পুলিশ এখনো স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করতে পারছে না। এই সুযোগে যে যার মতো আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, গত তিন মাসে অর্ধশতাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। দ্রুততম সময়ে ডাকাতির ঘটনায় আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা রহস্য উদ্ঘাটন করেছি। কিছু আসামি পলাতক আছে। ঘটনা ঘটতে পারে কিন্তু মানুষ প্রতিকার পাচ্ছে কি না- সেটাই হলো বিবেচ্য বিষয়। সেই হিসাবে আমরা বলতে পারি, আমরা সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করছি চ্যালেঞ্জগুলো। চ্যালেঞ্জ থাকবেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটা শূন্যতা ছিল। সেই সুযোগে যারা পেশাদার অপরাধী সেই লোকগুলো পুরোদমে তাদের অপরাধ বাড়িয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি খারাপ হয়েছিল। এখন পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হয়েছে এবং ক্রমেই আরও ভালো হবে বলে আশা করছি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে গত তিন মাসে গণপিটুনিতে খুন হয়েছেন অন্তত ৬৮ জন। এ সময় ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৭৮টি। একই সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুরাও হামলার শিকার হয়েছেন। আদালত প্রাঙ্গণসহ বিভিন্ন স্থানে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে সংঘর্ষ সহিংসতায় চারজন নিহত হওয়ার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
সরকার পরিবর্তন-পরবর্তী সামাজিক সহিংসতার ঘটনা নিয়ে পৃথক কোনো সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে হত্যার ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ৪ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৪৮ জন নিহত হয়েছে। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, এরা সবাই হত্যার শিকার হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত অর্ধশত মানুষকে বিভিন্ন স্থানে হত্যা করা হয়েছে। এর বাইরে নারী শিশু অপহরণ ও ধর্ষণ, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের পাশাপাশি পারিবারিক বিরোধের জের ধরেও হত্যার ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আগামী তিনমাসের মধ্যে পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া আরও বলেন, আমরা আশা করি যে, ছয় মাসের মধ্যে একটা টাইমফ্রেমের মধ্যে আগামী তিন মাসের মধ্যে আমরা পুরোপুরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারব। এবং পুলিশ পুরোপুরি ফাংশনাল হবে। তিনি জানান, সে লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় খোদা বক্সকে নিয়োগ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা হচ্ছে প্রায়োরিটি ওয়ান। কারণ এটার সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে সেনা সদরের কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, সেনাবাহিনী দেশের সাত শতাধিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। লুট হয়ে যাওয়া ৬ হাজার অস্ত্র, দুই লক্ষাধিক গুলি উদ্ধার করেছে এবং এতে সম্পৃক্ত আড়াই হাজার লোককে গ্রেপ্তার করেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নতির জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করছে সেনাবাহিনী। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পাওয়ার পরের যে স্ট্যাটিস্টিক, সেটাতে আগের তুলনায় অপরাধের নথিভুক্ত রেকর্ডের সংখ্যা কমেছে। তার মানে পরিস্থিতির অবনতি হয়নি। সেনবাহিনী এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা সবাইকে সম্পৃক্ত করে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে এবং আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে সিচুয়েশন আরও ভালো হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সেনা সদর এক ব্রিফিং করে এ কথা জানিয়েছেন কর্নেল খান।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলছে। আশা করি দ্রুতই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।