.
সময়সাপেক্ষ হলেও দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আগামীর জন্য এমন পলিসি করা হচ্ছে যাতে কেউ আর টাকা পাচার করতে না পারে।
শনিবার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভবিষ্যতে কেউ টাকা পাচার করলে ধরা পড়বে। প্রাইভেট কিংবা পাবলিক সেক্টর যেই হোক ধরা পড়বে। অর্থনৈতিক খাতে যেভাবে লুটপাট হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে কাজ হচ্ছে। অর্থনীতিতে শুধু উন্নয়ন দেখানোর যে প্রবণতা, সেই উন্নয়ন কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। রাজস্ব খাতে পলিসি আর ইমপ্লিমেন্টশন আলাদা করা হবে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের দরকার আছে। কিন্তু তাদের কারণে হাত ঘুরে পণ্যের দাম বাড়ে। হাত কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, রাজস্ব খাতে পলিসি আর ইমপ্লিমেন্টশন আলাদা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অনেক প্রকল্প করা হয়েছে, সম্ভাব্যবতা যাচাই করা হয়নি। আদানির বিষয়ে কোনো করই দেওয়া হয়নি। আদানিকে টাকা দেওয়ার জন্য সময় নেওয়া হয়েছে। সংস্কারের ক্ষেত্রে মাল্টিলেটারাল, বাইলেটারাল সবাই সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে বিদেশী সহযোগীরাও সহায়তা কমিয়ে দেবে।
তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে অর্থনীতিতে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার স্বল্পমেয়াদি সংস্কারকাজ চলছে। এরই মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। তবে সংস্কারের মাধ্যমে দ্রুত পুরো অর্থনীতির আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়।
সব কিছু এখন থেকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য আমরা একটি নতুন রাস্তা তৈরি করছি। পরে যারা আসবে তাদের এ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হবে। তা হলেই শান্তি ফিরে আসবে। যদি পুনরায় দুর্নীতি শুরু হয় তা হলে জনগণ আবারও ফুঁসে উঠতে পারে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের আয়োজনে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যান্ড ইকোনমিক রিফর্মস ইন বাংলাদেশ শীর্ষক সংলাপে দেশের আর্থিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার নিয়ে প্যানেল আলোচনা, পোস্টার প্রেজেন্টেশন এবং আর্থিক খাতের চলমান চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা আরও বলেন, সবাই বলছে এত কিছু করার পরও মূল্যস্ফীতি কেন কমছে না। এর প্রধান কারণ আগের সরকারের ভুল নীতি। এতদিন বিবিএসসহ অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান যেসব তথ্য দিয়েছে সেগুলোতে প্রশ্ন রয়েছে। আমি অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি তথ্যপ্রবাহ সঠিক রাখতে। সঠিক তথ্য না এলে অন্য তথ্যগুলো ভুল আসবে। নীতিমালা প্রণয়ন ঠিক হবে না। এতদিন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছিল না বলে এ সমস্যা হয়েছে। একের পর এক দুর্নীতি ও অন্যায় হয়েছে, যার মাশুল দিচ্ছে দেশের জনগণ।
তিনি বলেন একটি প্রজেক্ট থেকে কত টাকা আয় হবে, কত টাকা ব্যয় হবে, কত দিন সময় লাগবে এবং এসব প্রজেক্টের বিপরীতে নেওয়া ঋণের সুদের হার কি হবে, এসব বিষয়ে কোনো গবেষণা করা হয়নি। উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পরই একটি সংস্থা আমাদের উচ্চ সুদে ঋণ দিতে চেয়েছিল। আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ উচ্চ সুদের ঋণ নিলে আমরা পরিশোধ করতে পারব না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য সাবেক গভর্নর সম্পর্কে তিনি বলেন, উইথ ডিউ রেসপেক্ট, আমি বলতে চাই সাবেক গভর্নর ৪২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করতে করতে ৩০ বিলিয়নে নিয়ে এলেন। কারণ ছিল বৈদেশিক মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল করা। কিন্তু কোনো কাজই হয়নি। ১২ বিলিয়ন ডলার নিঃশেষ করে তিনি এখন ঘুমিয়ে আছেন। কিন্তু কোথায় আছেন জানি না। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পলিসিগত লিগ্যাসি বা নীতিগত দীর্ঘসূত্রতা পেয়েছি। যার কারণে কোনো কিছু পরিবর্তন করতে চাইলেই দ্রুত করা যায় না।
সময় সাপেক্ষ হলেও দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আগামীর জন্য এমন পলিসি করা হচ্ছে, যাতে কেউ অর্থ পাচার করতে না পারে।
অন্যদিকে সংলাপে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও উন্নয়ন বয়ানের সমালোচনা করে বলেন, উন্নয়নের যে বয়ান সে উন্নয়নের বয়ানের ব্যবচ্ছেদ না করতে পারি, তাহলে এগোনো সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, উন্নয়নের ট্রাজেক্টরির সমস্যা হচ্ছে প্রবৃদ্ধির যে চিত্র আমাদের দেওয়া হচ্ছে তাতে তথ্য-উপাত্তের রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে জিডিপি বাড়ছে কিন্তু বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ছে না।
তথ্য-উপাত্ত যে প্রশ্নবিদ্ধ তা বোঝাতে তিনি বলেন, এত জিডিপি হচ্ছে কিন্তু ট্যাক্স জিডিপি বাড়েনি। অনেক বছর হলো এটা ৮-৯ শতাংশে আটকে গেল এত টাকা কোথায় গেল?
ব্যাংকিং খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবচেয়ে বড় সমস্যা তৈরি করেছে উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মাসোহারা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরে লোক রাখা হয়েছিল। তারা টাকা ছাপিয়েছে, ভুয়া রিজার্ভ দেখিয়েছে। ব্যাংক চালানোর মতো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এমন ব্যক্তিকে ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশের দুটো কিডনি। একটি ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর, আরেকটি এনার্জি সেক্টর। দুটোই খেয়ে ফেলেছে বিগত সরকার। যারা এনার্জি সেক্টর খেয়েছে, তারাই আবার ফিন্যান্সিয়াল সেক্টর খেয়েছে।
তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে প্রবৃদ্ধির তথ্য ও উপাত্তে মারাত্মক সমস্যা ছিল। তথ্যের রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে, যেখানে ট্যাক্স জিডিপি বাড়েনি। ট্যাক্স নাই, বিনিয়োগ নাই আর দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখাতে গিয়ে সামাজিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্য শিক্ষায় গুরুতর অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
দেবপ্রিয় বলেন, আমরা মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ে আছি। রাষ্ট্রের মেরামত যদি না হয়, দুই পয়সার সংস্কার করে কোনো লাভ হবে না। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনা না গেলে, সংস্কারের পথে এগোনো সম্ভব নয়।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার পর, যদি দ্রুত সংস্কার না করা যায় তা হলেও এগোনো সম্ভব হবে না বলেও মন্তব্য করেন সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো।
বিগত সময়ে বিভিন্ন খাতের মধ্যে ‘ইমব্যালেন্স’ তৈরি করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেউ কেউ বলে আমরা কি মিডল ইনকাম ট্র্যাপে পড়তে যাচ্ছি? আমি মনে করি, আমরা এরই মধ্যে মিডল ইনকাম ট্র্যাপেই আছি।
তিনি বিনিময় হার, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনীতির অন্যান্য জায়গায় স্থিতিশীলতা আনতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ‘আপিল’ করেন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক ব্যাংকের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর সেলিম আর এফ হোসেন এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের কমিশনার ফারজানা লালারুখ।
