ড. মুহাম্মদ ইউনূস
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সকল মানুষের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া যায় এমন একটি অর্থনীতি গড়ার পর জোর দিয়ে বলেছেন, আসুন আমরা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করি, একে অপরের কথা শুনি এবং একটি নতুন পৃথিবী কল্পনা করার সাহস করি, যা পরিবেশগতভাবে নিরাপদ পৃথিবীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলি যেখানে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফল সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হবে, শুধু কিছু বিশেষ সুবিধাভোগীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না।’
জুলাইয়ের ঐক্যবদ্ধ শক্তি ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করেছে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশের যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে সব অন্যায়, অবিচার মোকাবিলা করা যায়। শুধু তাই নয়, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে বদলে দেওয়া যায় ইতিহাসের গতিপথ। যেটা আমরা জুলাই-আগস্টে দেখিয়েছি। আগামী দিনেও সবাইকে দেশ-জাতির কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
শনিবার রাজধানী সোনারগাঁও হোটেলে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজে (সিজিএস) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন। সম্মেলনে দেশ-বিদেশের ৮০০ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বক্তব্যে কল্যাণমূলক দেশ গড়ে তুলতে তিন শূন্যের ধারণার ওপর ভিত্তি করে একটি পৃথিবী তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এই ধারণা হলো-শূন্য কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদের কেন্দ্রীকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব। এর জন্য, তিনি সামাজিক ব্যবসা প্রচলনের কথা বলেন, যা মানুষের সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দেয়, কেবলমাত্র মুনাফা করা যার মূল উদ্দেশ্য নয়। একই সঙ্গে যুবকদের চাকরিপ্রার্থী না বানিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ওপরও জোর দেন প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টা উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য দ্রুত ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান এবং এমন একটি অর্থনীতি গড়ার ওপর জোর দেন যেখানে সবাই উপকৃত হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কোনো অন্যায়, দোষ না করেও এ দেশের মানুষ কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে। অনেক বড় শক্তির মুখোমুখি হওয়াতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু আমরা এটাও জানি, যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, যখন আমরা এক হয়ে কাজ করি, তখন আমাদের ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করার ক্ষমতা আছে, যেমনটি আমরা ১০০ দিন আগে বাংলাদেশে করেছি।
তিনি বলেন, মাত্র একশ’ দিন আগে একটি অনন্য রাজনৈতিক উত্থানের সম্মুখীন হয়েছিল বাংলাদেশ। গত ১৬ বছর ধরে চলা একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটিয়েছে ছাত্ররা। আমি এই সম্মেলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অতিথিদের কাছে একটি সদ্য উদীয়মান দেশে স্বাগত জানাই। নিজেকে নতুন বাংলাদেশ বলে অভিহিত করছি।
জুলাই বিপ্লবে প্রায় ১ হাজার ৫০০ ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ২০ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, এই সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা তাদের শ্রদ্ধা জানাই, যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, যারা সারা জীবনের জন্য তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চোখ এবং অনেক শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। তাদের প্রতি সমবেদনা জানাই।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বে অব বেঙ্গল কনভারসেশনের উদ্বোধন করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। এই সময়ে এ ধরনের সমাবেশের আয়োজনের জন্য সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজকে ধন্যবাদ জানাই। এই সম্মেলন মনের মিলনের চেয়েও বেশি কিছু উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে অনেক কিছু নিজেদের মধ্যে ভাগ করা যাবে।
সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিদেশীদের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড দেখার জন্য রাজধানী ঘুরে দেখার আমন্ত্রণ জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ঠিক একশ’ দিন আগে এই শহরে যা ঘটে গেছে, তা আপনার নিজ চোখে দেখে যান। জুলাই বিপ্লবের সময় তরুণদের আবেগ এবং আকাক্সক্ষাকে প্রকাশ করে রঙিন চিত্রে আঁকা রাস্তায় দেওয়ালগুলো দেখুন। দেখতে পারবেন কীভাবে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্ম কী চায়, তাদের অভিব্যক্তি দেখে যে কেউ অবাক না হয়ে পারবেন না। এই ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া না করার জন্য অনুরোধ করছি।
ড. মুহাম্মদ ইউনস বলেন, এই বিপ্লবের কোনো ডিজাইনার ছিল না, কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ছিল না এবং কোনো সংস্থা এটিকে অর্থায়ন করেনি। তরুণরা তাদের নিজের শক্তিতে করেছে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার বা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি এসব বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারব।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রথম সারিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতি বছর, উপকূলীয় জেলার মানুষগুলো নানা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এই সংকট মোকাবিলায় অবিলম্বে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের প্রয়োজন। তরুণদের দেশ আমাদের।
তিনি বলেন, ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে অর্ধেক জনসংখ্যার বয়স ২৭ বছরের কম। কত বড় শক্তি। তাদের এই সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে অনেক শক্তিশালী করে তোলা সম্ভব। আমাদের তরুণদের শক্তি আছে বিশ্বকে টেকসই উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়ার, আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সহযোগিতা, সাহস এবং নিজেদের মধ্যে শেয়ার করার মানসিকতা ও অটুট বিশ্বাস।
এই সম্মেলনের মাধ্যমে কীভাবে একটি নতুন বিশ্ব গড়তে হবে সেই বিষয়ে বিতর্ক এবং চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের তরুণরা আমাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে নিয়ে গেছে। আসুন একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করি, একে অপরের কথা শুনি এবং পরিবেশগতভাবে নিরাপদ গ্রহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নতুন জীবনধারাসহ একটি নতুন বিশ্ব কল্পনা করার সাহস করি। এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলুন যেখানে প্রযুক্তির ফল, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সব মানুষ সমানভাবে ভাগ করে নেয়, বিশেষ সুবিধাভোগী কয়েকজনের একচেটিয়া যাতে না হয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা চ্যালেঞ্জ ও জটিলতার দ্বারা পরিবেষ্টিত সময়ে বাস করি। অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার বা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি যাই হোক না কেন, আমরা এমন সমস্যার মুখোমুখি হই যা অপ্রতিরোধ্য। তবুও বাংলাদেশে আমরা স্থিতিস্থাপকতা, প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়া এবং এটি থেকে সুযোগ তৈরি সম্পর্কে কিছু জানি। কয়েক দশক আগে আমি ব্যক্তিগতভাবে গ্রামবাসীর সঙ্গে কাজ করে, তাদের সাহস দেখে এবং তাদের শক্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এটি শিখেছি। সেই অভিজ্ঞতাগুলোই আমাকে শিখিয়েছে, প্রতিটি সমস্যার একটি সমাধান থাকে।
সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনা অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বক্তব্য রাখেন। সাবেক বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অতিথিরা বক্তব্য রাখেন। তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনে ৭৭টি সেশনে গবেষক, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকসহ বিভিন্ন পেশার আট শতাধিক ব্যক্তি অংশ নেবেন।