ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সংবিধানকে নানান সংশোধনীর মাধ্যমে নষ্ট করা হয়েছে 

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২০:২৭, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

সংবিধানকে নানান সংশোধনীর মাধ্যমে নষ্ট করা হয়েছে 

দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা, এর উচ্চ কক্ষের নাম জাতীয় পরিষদ, নিম্ন কক্ষ সংসদ। সংসদ নির্বাচন হবে প্রচলিত পদ্ধতিতে তিনশত আসনে। জাতীয় পরিষদের ২০০ আসন হবে সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে বন্টন হবে। আইন সভার মেয়াদ হবে চার বছর। 

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কেউ দু’বারের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং বিচারক নিয়োগে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কমিশন গঠনের বিষয়ে সুনিদ্দিষ্ট প্রস্তাব হাজির করা হয়েছে। ল রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ)। ফোরামের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সালেহ উদ্দিন এই খসড়া প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন।

খসড়া প্রস্তাবের উপর শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এম. আসাদুজ্জামান। 

বিশেষ অতিথি ছিলেন বিচারপতি এম. এ মতিন, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ, অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন ব্যারিষ্টার সারা হোসেন, বিচারক মাজদার হোসেন, এ্যাডভোকেট আহসানুল করিম, ব্যারিষ্টার মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান খান ,রাজা দেবাশীষ রায়, সাংবাদিক সোরহাব হোসেন, আইন শিক্ষক সাইমী ওয়াদুদ ,এ্যাডভোকেট শিমির মনির। খসড়া প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন সাংবাদিক সালেহ উদ্দিন । সভা পরিচালনা করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান জাবেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন সাধারন সম্পাদক মনিরুজ্জামান মিশন। 

সভাপতির বক্তৃতায় বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর  হোসেন বলেন ,ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে শয়তান পালিয়ে গেছে। সংবিধান নিয়ে কথা বলতে হবে। তাহলেই সমাধান আসবে। কোন সমালোচনা করলেই ধরে নিয়ে যায়, গুম হয়ে যায়, আয়না ঘরে নিয়ে যেতো। এমন লেখাপড়াহীন-দুর্নীতি পরায়ন পার্লামেন্ট চায় না। এমপি হতে মিনিমাম সার্টিফিকেট থাকতে হবে।   

প্রধান অতিথির বক্তৃতায় অ্যাটর্নি জেনারেল এম. আসাদুজ্জামান বলেন, পাঁচ বছর পর পর জনগণ যেন স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে পারলে সেই সংবিধান হবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক।  

আমার মনে হয়, এখনো বর্তমান সংবিধান বহাল রয়েছে। এই সরকার সংবিধান সংশোধন করতে পারবেন কি না সেটা ভেবে দেখতে হবে। কারণ অনুচ্ছেদ ৯৩ তে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ১০২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা যে কোন জেলা আদালতে দিতে পারবে বলে ১৫দশ সংশোধনী বেসিক স্ট্রাকচারের পরিপন্থী। ৫ বছর পর পর জনগন যেন তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যা যা লাগবে সেগুলো নিশ্চিত করতে পারলে সব ঠিক হবে। 

সুজন সম্পাদক ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন ,পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানকে কলুষিত করা হয়েছে । একই সঙ্গে পঞ্চদশ সংশোধনীকে ‘ভয়ানক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো অপরিবর্তনযোগ্য করার বিধান সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। 

অনেকের ধারণা, পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসবে। কিন্তু তা ঠিক নয়। কারণ সংসদে পাশ না হলে এর কোনো কার্যকরিতা হবে না।  শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘কেমন সংবিধান চাই’ শীর্ষক আলোচনা সভায় নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান এ মন্তব্য  করেন তিনি।

সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষমতা কারও নেই জানিয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান সংবিধানে বহু অসঙ্গতি রয়েছে, যা পরিবর্তন করতে হবে। সংরক্ষিত আসন নিয়ে নির্বাচন সংস্কার কমিশন প্রধান বলেন, এখানে নারীকে প্রতীকী অবস্থায় নিয়ে যায়, সেই সঙ্গে অবমূল্যায়ন করা হয়। তাই সংস্কার প্রয়োজন। 

সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীকে ক্ষমতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ৪০০ আসন হলে ১০০টি নারীর জন্য বরাদ্দ করতে হবে, তাও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে। তৃণমূল পর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। কেননা এখন টাকা দিয়ে নারীদের আসন কিনে নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে অনুষ্ঠানে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান সাংবাদিক কামাল আহমেদ প্রশ্ন তোলেন গণপ্রজাতন্ত্র লেখা নিয়ে। সংসদ সদস্যদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিধান সংবিধানে সন্নিবেশিত করার পরামর্শও দেন তিনি। বলেন, তা না হলে নাগরিকদের ক্ষমতায়ন করা সম্ভব নয়। 
রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্র চর্চা করার পরামর্শ দিয়ে ৭০ এর অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়ার আহ্বানও জানান তিনি। অনুষ্ঠানে সাবেক বিচারক মাজদার হোসেন বলেন, এতগুলো জীবনের বিনিময়ে যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি, এ ব্যাপারে বিজ্ঞজনদের মতামত নিয়ে ঐক্যমত্য তৈরি করতে হবে। 

বিচারপতি এম এ মতিন বলেন ,যে সংবিধান ফ্যাসিস্টদের জন্ম দিয়েছে, বিপ্লবের পর সেই সংবিধান গুরুত্ব হারিয়েছে।বিপ্লব তো সংবিধানের আওতায় হয়নি। এই বিপ্লব ফেইল করলে তো বিপ্লবীরা  ফাঁসির আওতায় আসতো। নিম্ন আদালতকে সম্পূর্ণ হাইকোর্টের অধীনে আনতে হবে। তাহলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্ভব হবে। সংবিধানকে ছোট করতে হবে। এখন সংবিধান পুনর্লিখন হবে নাকি সংশোধন হবে, সেটা আমাদের (জনগন) সিদ্ধান্ত । সেটা তো সংবিধানে লেখা থাকবে না। পরবর্তীতে যেই সরকার আসবেন, তারা সেটা রেটিফাই করবে। তাহলেই সমস্যা থাকবে না। 

এ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন ,সংবিধানের মধ্যে দন্ড বিষয়ক তথ্য থাকার প্রয়োজন নেই।  অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন ,এমন প্রিন্টেড খসড়া কপি প্রথম কেউ দিয়েছে। সংবিধান বলতে রাজনৈতিক আয়োজন হিসেবে মানুষ দেখে। ৫৩ বছরে আমরা ভালো নির্বাচনী অবস্থা তৈরি করতে পারিনি। মৌলিক অধিকার চর্চা করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না করতে পারলে লাভ হবে না। সংবিধানের ফাংশনাল পাপেট নিয়ে আলোচনা করলে জনগনের বেশি লাভ হবে। 

ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ বলেন ,৭২ এর সংবিধানে অনেক কিছু আসেনি। সেগুলো নতুন করে যুক্ত করা যেতে পারে। বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি করার বিষয়ে গুরুত্ব দেন। আদিবাসীদের অধিকারের বিষয় সংবিধানে থাকা উচিত।  মাসদার হোসেন বলেন ,সংবিধানকে বার বার ব্যক্তি স্বার্থে ম্যালাফাইড উদ্দেশ্যে সংশোধন করা হয়েছে। বেসিক স্ট্রাকচার নিয়ে যা বলা আছে তা ভয়াবহ। এতগুলো জীবনের বিনিময়ে যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি তার সবাই মিলে জনমত সৃষ্টি করে ঠিক করতে হবে। 

ব্যারিষ্টার সারা হোসেন বলেন ,এখন সংবিধান পুণর্লিখন সম্ভব নয়। কিভাবে সংবিধান সংশোধন করা যাবে সেটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। বিচার ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। মিডিয়া সংস্কারটা গুরুত্বপূর্ণ। বাক স্বাধীনতার বিষয়টি আরো বিস্তৃত হতে হবে। 

এ্যাডভোকেট আহসানুল করিম বলেন, স্বৈরাচার হওয়ার জন্য সবাই সংবিধানকে ব্যবহার করে। বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ প্রয়োজন নেই।  বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে পূর্বে সে কোন রাজনৈতিক দলে যুক্ত থাকতে পারবে না। আমাদের মানসিকতা হলো স্বৈরাচার হয়ে যাওয়া।

এসআর

×