ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ বিপন্ন প্রায়

১৪১ প্রজাতির প্রবাল দ্বীপে বিলুপ্ত ১০১টি

এইচ এম এরশাদ, কক্সবাজার

প্রকাশিত: ০০:০৮, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

১৪১ প্রজাতির প্রবাল দ্বীপে বিলুপ্ত ১০১টি

.

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এই দ্বীপটি দেশের দক্ষিণের শেষ সীমানা টেকনাফে অবস্থিত। দ্বীপটি রক্ষার স্বার্থে চলতি নভেম্বর থেকে পর্যটকদের সেখানে রাত্রিযাপন বারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ পর্যটন গন্তব্য হচ্ছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এটিকে রক্ষা করতে পারলেই সেন্টমার্টিনের আয় দিয়ে সরকারের একাধিক উন্নয়ন কর্মকান্ড চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
জানা যায়, কিছু লোভী ব্যবসায়ীর কারণে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ লোক সেখানে রাত্রিযাপন করে আসছে। প্রতিবছর প্রায় দেড় লাখেরও বেশি লোক এ দ্বীপে ভ্রমণ করে থাকেন। সরকারের বন ও পরিবেশ উপদেষ্টার নির্দেশে নভেম্বরে পর্যটকদের সেখানে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আদেশের ফলে দ্বীপবাসীর কিছুটা ক্ষতি হলেও দ্বীপের স্থায়িত্বের জন্য যথেষ্ট উপকারে আসছে। কারণ দ্বীপ না থাকলে দ্বীপবাসীর কী উপকার হবে? তবে এক শ্রেণির হোটেল মালিক ও জাহাজ মালিকরা দ্বীপের বাসিন্দাদের উস্কানি দিয়ে চলেছে। জাহাজ মালিকরা টেকনাফের ইনানী জেটিঘাট থেকে জাহাজ ছাড়ার ব্যবস্থা নিতে গ্রামবাসীদের নিয়ে মানববন্ধন করিয়েছেন। লোকজন জোগাড় করতে বিলিয়েছেন অঢেল টাকা। তবে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো ইনানী জেটিঘাট অপসারণের দাবিতে অনঢ় রয়েছেন। তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরে মানববন্ধন করে ইনানী জেটি সরানোর দাবিতে ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন।
সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে সরকারিভাবে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সম্প্রতি এ দ্বীপকে কেন্দ্র করে বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা সেন্টমার্টিন মেরিন প্রোটেকটিভ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। এমনিতে সমুদ্র উচ্চতাজনিত কারণে দ্বীপটি ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার ওপর অধিক পর্যটকের চাপ সেন্টমার্টিনের বিলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করছে। এ জন্যই দ্বীপটি রক্ষাকল্পে বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নভেম্বরে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। অন্যান্য বছরে এই দ্বীপে প্রতিদিন গড়ে ৬-৭ হাজার পর্যটক রাতযাপন করে। এতে অতিরিক্ত চাপ পড়েছে দ্বীপের ওপর। 
সেন্টমার্টিন কক্সবাজারের টেকনাফের অধীনে থাকা একটি ইউনিয়ন হলেও এই দ্বীপ দেখতে লোকজন আসে প্রতিটি জেলা থেকে। তারা রাতযাপন করতে না চাইলেও হোটেল মালিক ও ভাড়াটিয়া মালিকরা তাদের এক প্রকারে জিম্মি করে রাতের দৃশ্য দেখার কথা বলে কক্ষ ভাড়া দেন। টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমার উপকূল থেকে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মাঝে নাফ নদীর মোহনায় সেন্টমার্টিন দ্বীপের অবস্থান। প্রায় ৫ হাজার বছর আগে এটি টেকনাফের মূল ভূখ-ের অংশ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তা সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যায়। এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান দ্বীপের দক্ষিণ পাশ জেগে উঠে। তার ১০০ বছর পর দ্বীপের উত্তর পাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরে এর বাকি অংশ ভেসে উঠে। 
জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে সেন্টমার্টিন সারা পৃথিবীর মধ্যে ছিল অনন্য। কিন্তু অতিরিক্ত পর্যটকের কারণে বর্তমানে দ্বীপের পরিবেশ বিপন্ন প্রায়। 
গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯৮০ সালে সেন্টমার্টিনে প্রায় ১৪১ প্রজাতির প্রবাল ছিল। মাত্র ৪ দশকে ১০১টি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে মাত্র ৪০ প্রজাতি প্রবাল দ্বীপে ঠিকে আছে। ১৯৮০ সালে এই দ্বীপের চারদিকে প্রায় ১ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটারে প্রবাল ছিল। বর্তমানে রয়েছে মাত্র ০ দশমিক ৩.৯ বর্গকিলোমিটার। মাত্র ৪০ বছরের  ব্যবধানে ৩ ভাগের এক ভাগও প্রবাল নেই দেশের একমাত্র এই প্রবালদ্বীপে। আন্তর্জাতিক গওসেচ সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে ২৯৪৫ সালের মধ্যে সেন্টমার্টিন সম্পূর্ণ প্রবালশূন্য হয়ে যাবে। ১৯৬১ সালে সেন্টমার্টিনে জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭৫০ জন। বর্তমানে এই দ্বীপের জনসংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। মাত্র দুই দশকেরও কম সময়ে সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৬ সালের দিকে প্রতি বছর সেন্টমার্টিনে পর্যটক আসত মাত্র ১৫০-২০০ জন। আর বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখের বেশি লোক এই দ্বীপ ভ্রমণ করে থাকে। পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১০-১৫ হাজার মানুষ এই দ্বীপে ঘুরতে আসে। সে কারণে সেন্টমার্টিনে বহু হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। রূপ নিয়েছে কংক্রিটের শহরে। ২০১২ সালে দ্বীপে মাত্র ১৭টি হোটেল ছিল। আর বর্তমানে হোটেল, মোটেল ও কটেজের সংখ্যা দেড়শ’র বেশি। এসব অবকাঠামো গড়ে তুলতে অবাধে চলছে বৃক্ষ নিধন। ৪০ বছর আগে দ্বীপে বৃক্ষ আচ্ছাধিত এলাকা ছিল সাড়ে ৪ বর্গকিলোমিটার। আর বর্তমানে বৃক্ষ আচ্ছাধিত এলাকা ৩ বর্গকিলোমিটারেরও কম। শুধু তাই নয়, সৈকতসংলগ্ন হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁ দোকান নির্মাণের জন্য কেয়াবন ও প্রাকৃতিক ঝোপঝাড় ধ্বংস করা হচ্ছে। পর্যটকরা যে পরিমাণ বর্জ্য এই দ্বীপে ফেলে বা ফেলছে- তার অধিকাংশ সরাসরি সাগরে গিয়ে পড়ে। ফলে দ্বীপের আশপাশের সাগর চরম মাত্রায় দূষিত হয়ে পড়েছে। 
কেন সেন্টমার্টিন নিয়ে এত মাতামাতি ॥ এই প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক করিম উল্লাহ কলিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক এইচএম নজরুল বলেন, বাংলাদেশের অন্য দ্বীপগুলো থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ আলাদা গঠনের। এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ। যদি পরিবেশের ক্ষতি হয়- তাহলে দ্বীপের প্রবালগুলো মরতে শুরু করবে। তখন দ্বীপ তার প্রাণ চাঞ্চল্য হারিয়ে ফেলবে। তখন দ্বীপের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। 

×