.
কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না রাজধানীর সড়ক দুর্ঘটনা। পুলিশের নানামুখী পদক্ষেপের পরও বেড়ে চলছে দুর্ঘটনা। অথচ নগরজীবনের অন্যান্য খাতে উন্নয়নের ব্যাপকতা থাকলেও সড়ক দুর্ঘটনা এখনো বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে। এ অবস্থায় চালু করা হয়েছে অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তি সম্পন্ন একটি সফটওয়ার। যা সত্যিকার অর্থেই কাজে আসবে বলে জানিয়েছেন সড়ক বিশেষজ্ঞরা। ‘ডার্ক ডিএমপি, নামের এই সফটওয়ার দিয়েই শনাক্ত করা যাবে যানচলাচলের গতিবিধি ও দুর্ঘটনার আগে পরের চিত্র, যা দিয়ে দায়ী চালকের বিরুদ্ধে নির্ভুলভাবে বিতর্কের বিরুদ্ধে উঠে সর্বগ্রহণযোগ্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের কঠোর শাস্তি নেওয়া যায় না। পরিবহন মালিক শ্রমিকদের দাপটের দরুণ সহজেই পার পেয়ে যায় ঘাতক চালক ও হেলপাররা। ডার্ক সফটওয়ার চালু করা গেলে এ ধরনের পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। প্রাথমিকভাবে রাজধানীতে আপাতত ৯০০ ট্রাফিক কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ডিএমপির ৮ বিভাগের সার্জেন্টরা মাঠে কাজ শুরু করেছেন। তারা ডাটা ইনপুটও দিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছে সড়ক দুর্ঘটনার আগে পরের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য বা কোনো উপায় নেই। ডার্ক সফটওয়্যারের মাধ্যমে নির্ভুলভাবে তথ্য, লোকেশনসহ দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ সংগ্রহ করা সম্ভব। এটি ব্ল্যাক স্পট বা দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান শনাক্ত ও দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করতে সহায়ক। এর পর ডিএমপি সেই তথ্য চিত্র ধরে ধরে দুর্ঘটনার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারবে।
এ বিষয়ে পুলিশ কমিশনার মো. মাইনুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেছেন, এটা অবশ্যই আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন। কেননা, এখানকার ট্রাফিক সদস্যদের দক্ষতা উন্নয়নে জাইকা আমাদের দেশে কাজ করার পাশাপাশি ডিএমপির অফিসারদেরও তাদের দেশে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আমাদের অফিসাররা ঢাকা মহানগর এলাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত করতে সক্ষম হবেন। ডার্ক সফটওয়্যারের মাধ্যমে সড়কে দুর্ঘটনার চিত্র তুলে আনা সম্ভব। এতে দুর্ঘটনার কারণ জানা ও সমাধান করা যাবে। যে সফটওয়্যারটি উদ্বোধন করা হয়েছে, সেটি একটি অত্যাধুনিক সফটওয়্যার। এ প্রশিক্ষণে যেসব অফিসার ও ফোর্স অংশ নিয়েছে, তারা প্রশিক্ষণ শেষে তাদের সেই অভিজ্ঞতা সঠিকভাবে কর্মক্ষেত্রে যদি প্রয়োগে করতে পারেন, তাহলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। পাশাপাশি সড়কের শৃঙ্খলাও ফিরবে। তাতে স্বস্তিও ফিরবে নগরবাসীর মাঝে। অন্যদিকে বেপরোয়া চালকরাও সতর্ক হয়ে যাবে। তারা এখন আর সহজে পার পেয়ে যাবে না আইনের ফাঁক-ফোকর কিংবা তথ্যের অভাবে।
জানা গেছে, ঢাকা রোড ট্রাফিক সেফটি নামে নেওয়া এ প্রকল্পটিতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেবে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা)। জাইকা বিশেষজ্ঞ দলের সমন্বয়ে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় তৈরি করা হয়েছে ডিএমপির ডাটাবেজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস অব রোড ক্র্যাশ যা ‘ডার্ক ডিএমপি’ নামে পরিচিতি পাবে। ওই সফটওয়্যারটিতে মূলত তথ্য দেবেন ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্টরা। তারা দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে এই অ্যাপসে দুর্ঘটনার বিভিন্ন তথ্য ইনপুট দেবেন। সেসব তথ্য ডিএমপির সদর দপ্তরে জমা হবে এবং ভবিষ্যতে কীভাবে সড়ক দুর্ঘটনা শূন্যের কোটায় নামানো যায় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন ডিএমপির ঊর্ধ্বতনরা। ইতোমধ্যে এ জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ডিএমপির ৮ শতাধিক ডিসি, এডিসি, এসি, টিআই ও সার্জেন্ট।
প্রকল্পটির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার মো. মাহমুদ হাসান জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করা ফরমটি ছিল সম্পূর্ণই কাগজে-কলমে অর্থাৎ অ্যানালগ। হাতে লেখা ফরমে দুর্ঘটনার একটি বড় অংশের তথ্য রেকর্ড থাকত না। আবার যে রেকর্ডগুলো থানা থেকে আসত সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ থাকতো। এজন্য ডিআরএসসি অনলাইন বেসিসে একটি সফটওয়্যার তৈরি করে। যার নাম দেওয়া হয় ডার্ক সফটওয়্যার।যেমন- ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ড্রাইভার সফটওয়্যার রয়েছে। সেই সফটওয়্যারের আদলে ডিএমপির প্রয়োজন অনুসারে মোডিফাই করে ডার্ক সফটওয়্যার তৈরি করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য- যে কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ডাটাবেজের মাধ্যমে নিয়ে আসা এবং প্রকৃতপক্ষে ঢাকা শহরের সামগ্রিক দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা। আগে যে ফরম ছিল সেখানে দুর্ঘটনার প্রকৃত স্থান চিহ্নিত করা যেত না। বর্তমান সফটওয়্যারটিতে পিন পয়েন্ট লোকেশনের জন্য জিপিএস ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে প্রকৃত লোকেশন পাওয়া সম্ভব।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্যই সঠিক সময়ে সংরক্ষণ বা সংগ্রহ করা যায় না। ম্যানুয়ালী সেটা সংগ্রহ করা হয়। যেমন-কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ৬৭টি ফিল্ডের একটি ফরমে দুর্ঘটনার তথ্য পূরণ করতে হয় পুলিশকে। ফরমটি পূরণের পর থানায় রেকর্ড হয়। যদি কোনো দুর্ঘটনার পর কোনো এক পক্ষ থানায় মামলা বা জিডি করে তখনই শুধু ৬৭টি ফিল্ডের ফরম পূরণ করে থানায় জমা রাখা হয়। অন্যথায় দুর্ঘটনার শিকার উভয় পক্ষ যদি মীমাংসা করত তবে ফরমটি আর পূরণ করে না পুলিশ। সড়কে যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগই থানা-পুলিশের ঝামেলা এড়াতে উভয়পক্ষ মীমাংসা করে ফেলে। এতে বাস্তবতা হলো দুর্ঘটনার অনেক তথ্যই উঠে আসে না। যে কারণে সড়ক দুর্ঘটনার মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাও জটিল হয়ে পড়ে। আর কঠোর বিচার বা শাস্তি না থাকায় চালকরা বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে গাড়ি চালায়। দুর্ঘটনার প্রধান কারণই চালকের বেপরোয়া মনোভাব।
ডার্ক ডিএমপি সম্পর্কে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনার পর যে ফরমটি পূরণ করা হয় সেটা মান্ধাতা আমলের। আগে এক মাস পর থানা থেকে ডিএমপি সদর দপ্তরের অপারেশন্স বিভাগে জমা হতো দুর্ঘটনার ওই ফরমের তথ্য। তারপর একটি পুরনো অফলাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে দুর্ঘটনার তথ্যগুলো রেকর্ড করা হয়। হাতে লেখা ফরমে দুর্ঘটনার একটি বড় অংশের তথ্য রেকর্ড থাকে না।
আবার যে রেকর্ডগুলো থানা থেকে আসত, সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ থাকত। এ ধরনের সমস্যা ও জটিলতা নিরসনেই ডিআরএসসি অনলাইন বেসিসে এই সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে। সফটওয়্যারটিতে আটটি ক্যাটাগরি রয়েছে। এতে যে কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ডাটাবেজের মাধ্যমে নিয়ে আসা এবং প্রকৃতপক্ষে ঢাকা শহরের সামগ্রিক দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করার সুযোগ থাকছে। আগে যে ফরম ছিল , সেখানে দুর্ঘটনার প্রকৃত স্থান চিহ্নিত করা যেত না। ডার্ক সফটওয়্যারটিতে পিন-পয়েন্ট লোকেশনের জন্য জিপিএস ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে প্রকৃত লোকেশন পাওয়া সম্ভব। যেমন-দুর্ঘটনার সময়, তারিখ, রিপোর্টটি কোন অফিসার ইনপুট দিচ্ছেন তার তথ্য, জিপিএসে লোকেশনের তথ্য, হতাহতের তথ্য, দুর্ঘটনার ধরন, দুর্ঘটনার পেছনে সহায়ক কারণ, দুর্ঘটনার সময় আবহাওয়া ও দুর্ঘটনার চিত্র। ট্রাফিক সার্জেন্টরা খুব সহজেই ছবি তুলে দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র সফটওয়্যারে ইনপুট দিতে পারবেন। এটি ব্যবহার করে সার্জেন্টরাও উপকার পাবেন। দায়িত্ব পালনে তাদের ঝামেলাও অনেক কমে আসবে। ঢাকার কোনো সড়কে দুর্ঘটনা ঘটলে ওই এলাকার দায়িত্বরত সার্জেন্ট ঘটনাস্থল থেকে সফটওয়্যারে তথ্য দেবেন। প্রথমে তার মোবাইল ফোনে থাকা সফটওয়্যারে আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করবেন। এর পর দুর্ঘটনার সময়, তারিখ, জিপিএস লোকেশন, দুর্ঘটনার কারণ, এমনকি বৃষ্টি, কুয়াশা কিংবা রোদ সেসব তথ্যও একজন সার্জেন্ট খুব সহজেই ছবি তুলে সফটওয়্যারে ইনপুট দিতে পারবেন।
এ সম্পর্কে ট্রাফিক-রমনা বিভাগের সার্জেন্ট মো. রবিউল ইসলাম বলেন- আগে যেখানে বড় ধরনের দুর্ঘটনা হলে থানায় এফআইআর বা মামলা হতো। কিন্তু ছোটখাটো কিংবা মাঝারি ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে সড়কেই মীমাংসা হয়ে যেত। এতে দুর্ঘটনার কোনো তথ্য সংগ্রহ করা হতো না। বর্তমানে ডার্ক সফটওয়ারের মাধ্যমে যে জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে গেলেই অটোমেটিক লোকেশন নিয়ে নেবে। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যে এজাহার দায়ের হতো- সেই ডাটাগুলো ডিএমপিতে সংগ্রহ করা হতো। এখন ডার্ক সফটওয়্যারের মাধ্যমে যে কোনো দুর্ঘটনা- মামলা হোক কিংবা না হোক ছবিসহ সব ডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে দুর্ঘটনা রোধের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। গোটা রাজধানীর তথ্য যখন আমাদের কাছে থাকবে, তখন খুব সহজেই বলতে পারব কোন কোন স্পটে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে।