রাজধানীতে বেহাল যাত্রী ছাউনি। ভবঘুরেদের দখলে থাকে বেশিরভাগ যাত্রী ছাউনি
রাজধানীতে যাত্রী ওঠা-নামার জন্য বাস স্টপেজ নির্মাণ হয় কিন্তু ব্যবহার করা হয় না। এসব যাত্রী ছাউনী ও বাস স্টপেজ বর্তমানে মাদকসেবী, হকার, ভবঘুরের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। যাত্রী ছাউনীর সামনে বাস স্টপেজ থাকলেও সেখানে থামছে না বাস। অথচ এই সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে কয়েক দফায় প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।
তবে যথাযথ স্থানে যাত্রী ছাউনী তৈরি না করা এবং নগরপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা না থাকার কারণে এই দুরবস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তাই বাস স্টপেজ তৈরির পাশাপাশি জনসচেতনতা ও চালকদের কঠোর নির্দেশনা পালনের পরামর্শ তাদের। এ ছাড়া বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতির মাধ্যমে পুরো ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেন তারা।
এ বিষয়ে গণপরিবেহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা সিটির দুই মেয়র জনগণের সেবা দেওয়ার পরিবর্তে শুধু পয়সা ইনকামের ধান্দা করেছে। তাদের চিন্তা ছিল নতুন প্রকল্প নেওয়া। কিন্তু কি কাজ করলে জনগণের উপকার হবে সেটা তাদের চিন্তায় ছিল না। তা না হলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা যাত্রী ছাউনীগুলোর এই করুণ পরিণতি হতো না। ঢাকা পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা না থাকার কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। কোথায় বাস থামবে আরও কোথায় যাত্রী ছাউনী তৈরি করতে হবে, এটা তাদের পরিকল্পনায় ছিল না। যদি স্টপেজ ভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু করতে হয় তা হলে প্রথমে বাস রুট পারপিটের পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে এক রুটে একাধিক কোম্পানির বাস চলাচল করতে পারবে না। একই রুটে বিভিন্ন কোম্পানি বাস চলাচলের কারণে প্রতিযোগিতা করে যত্রতত্র থেকে যাত্রী ওঠা-মানা করা হয়। এতেই সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। কিন্তু মেয়ররা শুধু বাস স্টপেজ তৈরি করেই তাদের দায়িত্ব শেষ মনে করেছে। বাস থামানোর কোনো পরিকল্পনা করেনি। এক্ষেত্রে প্রকল্পের নামে জনগণের টাকা অপচয় করা হয়েছে। তাই এই অপচয় রোধে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কর্মকর্তা ও মেয়রদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার পরামর্শ দেন তিনি।
বাস থামে না যাত্রী ছাউনীতে ॥ জানা গেছে, রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় শতাধিক যাত্রী ছাউনী রয়েছে। অধিকাংশ যাত্রী ছাউনীতেই যাত্রীদের বসার মতো অবস্থা নেই। যাত্রী ছাউনীগুলোর অধিকাংশের বসার চেয়ারগুলোর বিভিন্ন অংশ, ওপরের ছাউনী খুলে নিয়ে গেছে। কোনো কোনো যাত্রী ছাউনী পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড় কিংবা মলমূত্র ত্যাগের স্থানে। সব সময় অপরিচ্ছন্ন থাকায় স্থান করে নিয়েছে পাগল ও ভবঘুররা। কোনো কোনো যাত্রী ছাউনীতে রাতে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। আবার অনেকগুলো দখল করে কেউ কেউ বসিয়েছেন দোকান।
সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রীদের ওঠা-নামার জন্য এসব স্টপেজ ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করছে না বাস চালকরা। বাস স্টপেজ ব্যবহার না করে নিজেদের ইচ্ছামতো বিভিন্ন সড়কের মাঝে ও মোড়ে যাত্রী ওঠা-নামা হচ্ছে। এতে একদিকে সড়কে তৈরি হচ্ছে যানজট। অপরদিকে তাড়াহুড়া করে যাত্রীরা বাসে উঠতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা।
এ সব যাত্রী ছাউনী ও স্টপেজের বেশিরভাগ স্থানে বাস থামানো হয় না বলে অভিযোগ করেন যাত্রীরা। রাজধানীর সায়েদাবাদ জনপথ মোড়ে আলী আজম নামের এক যাত্রী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সায়েদাবাদ জনপথ মোড়ে যেখানে যাত্রী ছাউনী তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বাস থামে না। যাত্রী ছাউনী দখল করে রাখে ভাসমান মাদকসেবীরা। এ ছাড়া যাত্রী ছাউনীর অর্ধেক দখলে থাকে ভাঙাড়ি দোকানের ময়লায়। এ ছাড়া যাত্রী ছাউনীটি রাস্তা থেকে দেখা যায় না। কারণে আন্তঃজেলার বড় বড় বাস পার্কিং করে রাখা হয় সামনের সড়কে।’ তাই বাধ্য হয়ে মূল রাস্তা থেকে বাসে উঠতে হয় বলে জানান তিনি।
বাস চালকরাও জানান একই সমস্যার কথা। মনির নামের শিকড় পরিবহনের এক চালক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘যে সব স্থানে বাস স্টপেজগুলো তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বাস রাখা ও যাত্রী ওঠা-নামার অবস্থা নেই। কারণ খানাখন্দ ও ভাঙাচোরা ভরা বাস স্টপেজের সামনের সড়ক। এ ছাড়া যাত্রীছাউনীতে যাত্রী থাকে না। হকার ও মাদকসেবীদের দখলে এসব যাত্রীছাউনী। এ ছাড়া অনেক স্থানে নির্মাণের কিছুদিন পর ভেঙে গেছে যাত্রীছাউনী। তাই যেখানে যাত্রী পাওয়া যায় সেখান থেকেই যাত্রী ওঠানো হয়।’ সিটি করপোরেশন থেকে বাস স্টপেজের স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
কোটি টাকার স্টপেজ এখন পরিত্যক্ত ॥ ডিএসসিসির সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফা বাস স্টপেজগুলো নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছে। গত বছর নতুন করে আরও ৪০টি বাস স্টেপেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪টি যাত্রী ছাউনী মেরামত করা হয়েছে। ২০২১ সালে রাজধানীর ঘাটারচর-মোহাম্মদপুর-জিগাতলা-প্রেস ক্লাব-মতিঝিল-যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর পর্যন্ত ২১ নম্বর রুটের চালু হয় ঢাকা নগর পরিবহন বাস সার্ভিস। এই রুটে ২২টি বাস স্টপেজ নতুন করে নির্মাণ করা হয়। এ ছাড়া ঢাকা নগর পরিবহন ২২ নম্বর রুটে তিনটি, ২৩ নম্বর রুটে ৯টি, ২৬ নম্বর রুটে ৬টি ও ২৮ নম্বর রুটে ৪টি স্টপেজ নতুন করে নির্মাণ করা হয়। পাশাপাশি আরও চারটি যাত্রী ছাউনী মেরামত করা হয়। নতুন প্রতিটি বাস স্টপেজ তৈরি করতে প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
এর আগে দুই কোটি আশি লাখ টাকা ব্যয়ে ৪০টি বাস স্টপেজ নির্মাণ করেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এ ছাড়া ২০১৮ সালে রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ১৩০টি বাস স্টপেজ ও যাত্রী ছাউনী নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের চাহিদা মোতাবেক এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণকে ৭০টি ও উত্তরকে ৬০টি বাস স্টপেজ ও যাত্রী ছাউনী নির্মাণের জন্য তালিকা দেওয়া হয়। তালিকা অনুযায়ী ঢাকা সিটি করপোরেশন দুটি প্রকল্পের আওতায় ৩৮টির নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ২৮টি দক্ষিণ সিটিতে এবং বাকি ১০টি উত্তর সিটিতে। এতে প্রায় ৬ দশমিক ৫ কেটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক মেগা প্রকল্পের আওতায় এগুলোর নির্মাণকাজ হয় বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
ডিএসসিসির নতুন নির্মাণ করা বাস স্টেপেজগুলো হলো-ঢাকা নগর পরিবহনের ২১ নম্বর রুটে রাজধানীর সোবহানবাগ (পশ্চিম মসজিদ সংলগ্ন), শুক্রাবাদ (৩২ এর বিপরীতে ফুটওভার ব্রিজ সংলগ্ন), কলাবাগান (পূর্ব পাশ ডলফিন গলির দক্ষিণে), কলাবাগান (পশ্চিম-খেলার মাঠ সংলগ্ন), শংকর (পূর্ব-ফুটওভার ব্রিজ সংলগ্ন), শংকর (পশ্চিম-ফুটওভার ব্রিজ সংলগ্ন), ধানমন্ডি-১৫ (পূর্ব কাকলি বিদ্যালয়ের সামনে), ঝিগাতলা (পূর্ব), ঝিগাতলা (পশ্চিম), সিটি কলেজ (উত্তর-স্টার হোটেল সংলগ্ন); সিটি কলেজ (দক্ষিণ-স্টার হোটেলের বিপরীত পার্শ্বে), ধানমন্ডি-৪ (পূর্ব-আড্ডা রেস্তোরাঁ এর সামনে), ধানমন্ডি-৪ (পশ্চিম-ল্যাব এইড হাসপাতালের সামনে), সায়েন্সল্যাব (উত্তর-বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কেন্দ্রের সামনে), শাহবাগ (দক্ষিণ- পূবালী ব্যাংক এর সম্মুখে), কাকরাইল (উত্তর- এবি ব্যাংকের সম্মুখে), কাকরাইল (দক্ষিণ-তমা কন্সট্রাকশনের নবনির্মিত ভবনের সামনে, ফকিরাপুল (উত্তর-ফকিরাপুল মোড় সংলগ্ন), নয়াপল্টন (দক্ষিণ-কমিউনিটি সেন্টারের সামনে), মতিঝিল (শাপলা চত্বর হিরাঝিল এর সন্নিকটে), শাহবাগ পিজি হাসপাতালের দক্ষিণ পার্শ্বে এবং সায়েদাবাদ ওয়ান্ডারল্যান্ড পার্কের সম্মুখে।
নগর পরিবহনের ২২ নম্বর রুটে ৩ টি বাস স্টপেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো হলো- মৎস্য ভবন মোড় রমনা পার্ক গেট সংলগ্ন (মাওলানা ভাসানী সড়কের উত্তর পার্শ্বে), কাজলা মসজিদ সংলগ্ন (ঢাকা ডেমরা প্রধান সড়কের উত্তর পার্শ্ব) এবং কাজলা মসজিদের বিপরীতে (ঢাকা ডেমরা প্রধান সড়কের দক্ষিণ পার্শ্ব)।
নগর পরিবহনের ২৩ নম্বর রুটে ৯টি বাস স্টপেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো হলো-সোবহানবাগ ফুটওভার ব্রিজ হতে উত্তর দিকে (মার্লিন এর বিপরীত পার্শ্বে), গুলিস্তান মুক্তাঙ্গন পার্কের বিপরীতে সচিবালয় সংলগ্ন, দৈনিক বাংলা মোড় সংলগ্ন সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্সুরেন্সের সামনে; দৈনিক বাংলা মোড় এক্সিম ব্যাংক সংলগ্ন; মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন; কমলাপুর রেল স্টেশন সংলগ্ন (আউটার সার্কুলার রোডের পূর্ব পার্শ্বে); কমলাপুর রেল স্টেশনের সামনে; গোলাপবাগ মাঠ সংলগ্ন (অতিশ দিপঙ্কর সড়কের পূর্ব পার্শ্বে এবং গোলাপবাগ পুলিশ কোয়ার্টার ভবন সংলগ্ন (অতিশ দিপঙ্কর সড়কের পশ্চিম পার্শ্বে);
নগর পরিবহনের ২৬ ও ২৮ নম্বর রুটে আরও ৯টি বাস স্টপেজ নতুন নির্মাণ করা হয়। এগুলো হলো- নিউমার্কেট ফুটওভার ব্রিজ সংলগ্ন মিরপুর সড়কের পশ্চিম পার্শ্বে; চাঁদনী চক মার্কেট সংলগ্ন (মিরপুর সড়কের পূর্ব পার্শ্বে; আজিমপুর আধুনিক নগর মার্কেট সংলগ্ন; চাঁনখারপুল শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট সংলগ্ন (জহির রায়হান সড়কের উত্তর পার্শ্ব; চাঁনখারপুল শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট সংলগ্ন (জহির রায়হান সড়কের দক্ষিণ পার্শ্বে); যাত্রাবাড়ী টোল প্লাজা সংলগ্ন (পশ্চিম পার্শ্বে)। ২৮ নম্বর রুটে বাস স্টপেজ- কাকরাইল মোড় হতে ৬০ মিটার দূরে বীর উত্তম শামসুল আলম সড়কের দক্ষিণ পার্শ্বে নাসির উদ্দীন টাওয়ারের সামনে; মালিবাগ মোড় হতে ৭০ মিটার দূরবর্তী অতীশ দিপঙ্কর সড়ক এর উত্তর পার্শ্বে; খিলগাঁও ফ্লাইওভারের দক্ষিণ পার্শ্বে মাল্টিপ্লান সংলগ্ন অতীশ দিপঙ্কর সড়কের পূর্ব পার্শ্বে; এবং বৌদ্ধমন্দির সংলগ্ন কমলাপুর কলেজের পার্শ্বে অতীশ দিপঙ্কর সড়ক এর পূর্ব পার্শ্বে। এসব বাস স্টেপেজের বেশীর ভাগ এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ময়লা-আবর্জনায় ভরা যাত্রীদের বসার বেঞ্চ, টিকিট কাউন্টারের বুথ হকার ও ভাসমান মাদকসেবীদের দখলে।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তত্ববধায়ক প্রকৌশলী রাজিব খাদেম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে আধুনিক এ সব যাত্রী ছাউনী ও বাস স্টপেজ তৈরি করা হয়েছে। ঢাকা নগর পরিবহনের বাস সার্ভিস পরিচালনার জন্য রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ৪০টি বাস স্টপেজ নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪ বাস স্টপেজ মেরামত করা হয়েছে। কিন্তু বাস চালকরা বেশি যাত্রীর আশায় স্টপেজগুলো ব্যবহার করে না। এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশেরর তদারকি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’