.
বর্তমান অন্তর্র্র্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো প্রশ্ন না তোলার বিধান রেখে নতুন একটি অধ্যাদেশ করতে যাচ্ছে সরকার। ‘অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ ২০২৪’ শিরোনামের এই খসড়ায় ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ। এর মাধ্যমে অন্তর্র্বর্তী সরকারের সব কাজ বৈধ ও মেয়াদ অনির্দিষ্ট হতে যাচ্ছে। খসড়াটি এখন গেজেট আকারে প্রকাশের অপেক্ষায়। তবে ঠিক কত দিনের মধ্যে অধ্যাদেশটি জারি হতে পারে, সেটি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় সবদিক মাথায় রেখেই খসড়াটি প্রস্তুত করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই সেটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হতে পারে বলে সরকারের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে এই অধ্যাদেশটি নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা না হলেও সিনিয়র আইনজীবীরা বলছেন সরকারের কার্মকা-কে একটি ‘আইনি বৈধতা’ দেওয়ার জন্যই এটি করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, খসড়ার শিরোনাম করা হয়েছে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ, ২০২৪।’ এতে বলা হয়েছে, সরকারের সিদ্ধান্ত আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বা অবৈধ ঘোষণা করা যাবে না।
এই অধ্যাদেশের খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যাতে সরকারের মেয়াদ নির্দিষ্ট না করে বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ সংসদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন না করা পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারই ক্ষমতায় থাকবে।
এই সরকারের কোনো কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টসহ অন্য কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না বা কোনো আদালত তা অবৈধ বা বাতিল করতে পারবে না। নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ, জরুরি অবস্থা ঘোষণায় প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নেওয়াসহ সার্বিক বিষয়কে আইনি ভিত্তি দিয়ে এই অধ্যাদেশের খসড়া করা হয়েছে।
বিগত ১৯ সেপ্টেম্বর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এই খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। সেটি এখন গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ সম্প্রতি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কার্যকর থাকবে। অধ্যাদেশটি যখন জারি হবে তখনই আপনারা জানতে পারবেন। তিনি বলেন, নানা দিক ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে।
সরকারি চাকরিতে কোটার বিরোধিতা করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সরকার পতনের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নিলে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর তিন দিন পর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তার আগেই ভেঙে দেওয়া হয় সংসদ।
এই সরকারের মেয়াদ কত দিন হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, এর মধ্যে আছে সাংবিধানিক সংস্কারও।
সংবিধানে বলা আছে, সংসদ ভেঙে দিলে ৯০ দিনের মধ্যে ভোট হতে হবে, আর কোনো দৈব দুর্বিপাকে সেটা করা না গেলে পরের ৯০ দিনেই হতে হবে নির্বাচন।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের আভাস দিয়ে একটি বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দিলেও সরকারের তরফে সেটি ব্যক্তিগত বক্তব্য বলে জানানো হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ২০২৫ সালের শেষে ভোট হতে পারে বলে একটি বক্তব্য দেওয়ার পরে সেটিও সরকারের বক্তব্য নয় বলে প্রতিক্রিয়া জানান ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি অবশ্য এরই মধ্যে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি তুলছে, তারা বলছে, সংবিধান সংশোধন বা সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত সংসদ, সেটিই হবে টেকসই। আরেক আলোচিত দল জামায়াতে ইসলামী শুরু থেকে আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন এমন একটি অবস্থান নিয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার শরিকদের কথা মাথায় না রেখেই সব কিছু করা হচ্ছে। এমনকি নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন করলে সেটি অগ্রহণযোগ্য হবে না।
সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, সংবিধান এবং বর্তমানে বলবৎ আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, সেই তারিখের মধ্যবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োগ করা ক্ষমতা, অধ্যাদেশ, বিধিমালা, প্রবিধানমালা, প্রজ্ঞাপন, আদেশ, কর্মকাণ্ড ও গৃহীত ব্যবস্থা আইনানুযায়ী যথাযথভাবে করা এবং গ্রহণ হয়েছে বলে গণ্য হবে। সুপ্রিম কোর্ট বা অন্য কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের কাছে এর বৈধতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না বা একে অবৈধ বা বাতিল করতে পারবে না।
‘অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠন ও কার্যধারা রক্ষণ’ সংক্রান্ত ধারায় বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন বা এর প্রধান উপদেষ্টা বা কোনো উপদেষ্টাদের নিয়োগ সম্পর্কে কোনো ত্রুটি রয়েছে, কেবল এ কারণে কোনো কাজ অবৈধ হবে না বা এ সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন বা মামলা করা যাবে না।
প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ, প্রধান উপদেষ্টা পরামর্শ গ্রহণ, সরকারের মেয়াদ ও পদমর্যাদার বিষয়ে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা যতজন উপদেষ্টা নির্ধারণ করবেন, সে সংখ্যায় উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাকে শপথ করাবেন রাষ্ট্রপতি। অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য ও সহয়োগিতা দেবে।
প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর এবং উপদেষ্টারা মন্ত্রীর পদমর্যাদা, পারিশ্রমিক ও সুযোগ-সুবিধা পাবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে নিজে লেখা ও স্বাক্ষরযুক্ত পত্রের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টারা পদত্যাগ করতে পারবেন।
পদত্যাগ, মৃত্যু বা অন্য কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবেন। প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণের বিষয়ে হয়েছে, বিদ্যমান অন্যান্য আইনে যা কিছুই বলা থাকুক না কেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রপতি কাজ করবেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণার বৈধতার জন্য ঘোষণার আগে তাকে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি স্বাক্ষর নিতে হবে।
এই বিষয়টি সুনির্দিষ্ট না করে সরকারের মেয়াদ বিষয়ে অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত অন্তর্র্বর্তী সরকার বহাল থাকবে। এই সরকার একটি অস্থায়ী বা সাময়িক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে বলেও এতে উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারীদের সহায়তায় সরকার কাজ করবে।
নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠানে এবং সংবিধান বা অন্য ে কোনো আইন দিয়ে নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য ও সহায়তা দেবে।
প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা নিয়োগে অযোগ্যতা ॥ তিনি যদি দেশের নাগরিক না হন এবং তার বয়স ২৫ বছর পূর্ণ না হয়, কোনো আদালত অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষিত হন; দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেয়ে থাকেন; কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন।
নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পার না হলেও এসব পদে নিয়োগ পাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ কোলাবোরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২ এর অধীন কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে এবং ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না’- এ বিষয়ে সম্মত না হন।
আগের অন্তর্র্বর্তীকালীন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ॥ তিন দশকেরও বেশি সময় আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা এসেছিল দেশে। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। পরে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হলে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মেয়াদ ছিল ৯০ দিন। তবে সর্বশেষ ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেয়। তবে এই সরকার ক্ষমতায় থাকে প্রায় দুই বছর। ২০১১ সালে এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক বলে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ওই বছরের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে নবম সংসদ।