.
দায়মুক্তি দিয়ে করা আইন অবৈধ এবং ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো ব্যক্তির একক ক্ষমতা গণতান্ত্রিক দেশে থাকতে পারে না। এটি সংবিধানের পরিপন্থি। আর তাই দেশের সব কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর ফলে ২০১০ সালের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় চলমান কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে আর কোনো বাধা থাকছে না। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে সরকারের হাজার কোটি টাকা গচ্চার হাত থেকে বাঁচতে আদালতের আদেশ হাতে পেলেই বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তবে হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক যে কোনো ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে মন্ত্রীর একক সিদ্ধান্ত রহিত করা হলেও বর্তমান সরকার চাইলে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতে পারবে। কিন্তু এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো প্রয়োজন দেশে আর নাই উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গলার কাঁটা হিসেবে পরিচিত এসব কেন্দ্র বন্ধ হলেই দেশের মঙ্গল।
২০১০ সালে দায়মুক্তি আইন বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ করে আওয়ামী লীগ সরকার। বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর অজুহাতে দলীয় সমর্থক ব্যবসায়ীদের উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয় আওয়ামী লীগ আমলে। এসব বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ৮০-৮৫ শতাংশ সক্ষমতায় ব্যবহার করা হবে- এমন শর্তে লাইন্সেস দেওয়া হলেও এসব কেন্দ্র গড়ে চলেছে ২৫-৩০ শতাংশ সক্ষমতায়। অর্থাৎ কেন্দ্রগুলো বছরের ৭০-৭৫ ভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই অলস বসে ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করলেও হাইকোর্টে একটি রিটের কারণে এতদিন সচল ছিল কেন্দ্রগুলো। কিন্তু যেহেতু এবার সর্বোচ্চ আদালতের রায় পাওয়া গেছে, সেহেতু এগুলো বন্ধে আর কোনো বাধা রইল না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কুইক রেন্টাল সংক্রান্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ এর ৯ ধারার অধীনে কোনো কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না এবং ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে মন্ত্রীর একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বলেন, দায়মুক্তি দিয়ে করা আইন অবৈধ এবং ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো ব্যক্তির একক ক্ষমতা গণতান্ত্রিক দেশে থাকতে পারে না। এটি সংবিধানের পরিপন্থি।
এক পরিসংখ্যান বলছে, গত ১৪ বছরে এই কেন্দ্রগুলোতে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। শুধু ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে বেশিরভাগই খরচ হতো কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নিজেদর স্বার্থে বছরের পর বছর বাড়ানো হয়েছে এগুলোর মেয়াদ। ডলার সংকটে যখন দেশের অন্যান্য খাত ধুঁকছে, তখন এই কেন্দ্রগুলোকে টিকিয়ে রাখা বিলাসিতা বলেও দাবি করেন তারা। তাই কলার কাঁটা এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৩২ হাজার কোটি টাকা। যার বেশিরভাগই গেছে এসব রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পরিচালন ব্যয়ে। এর আগের অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৮ হাজার কোটি টাকা। যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। টাকার অবমূল্যায়নসহ নানাবিধ কারণে মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে ছয় শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ। চলতি অর্থবছরেও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পরিচালন ব্যয় হিসেবে বরাদ্দ রাখা হয় ৪০ হাজার কোটি টাকা। যা থেকে বেশিরভাগ অর্থই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ভর্তুকি বাবদ ব্যয় হওয়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকির বেশিরভাগ অর্থই এসব বেসরকারি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ মেটাতে ব্যয় করা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও তাদের উৎপাদনক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট ফি কেন্দ্রগুলোকেই দিতে যার সম্পূর্ণটাই সরকারকে বহন করতে হয়। এই পরিমাণ অর্থ বিদ্যুতের অন্য কোনো উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে ব্যবহার হলে তা দেশের জন্য উপকার হতো বলে মনে করছেন তারা।
যেহেতু হাইকোর্টের রায় হয়েছে, সেহেতু এখন এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধে আর কোনো বাধা থাকছে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জনকণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমাদের চাহিদার তুলনায় এখন উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বেশি। যদিও কিছু কিছু জায়গায় সংকট রয়েছে। কিন্তু সেগুলো খুব বেশি না। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে এসব কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে এতদিন বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। আমরা ক্ষমতায় এসেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিশেষ আইন বাতিল করেছি। সেই হিসেবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এতদিন হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত একটি রিট থাকার কারণে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। এবার যেহেতু হাইকোর্ট এগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন, তাহলে বন্ধ করতে আর কোনো বাধা রইল না। কবে থেকে বন্ধ করার কার্যক্রম শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পত্রিকার প্রতিবেদনেই আমরা রায়ের বিষয়ে জানতে পেরেছি। আদেশ হাতে পাওয়া মাত্রই কার্যক্রম শুরু করে দেব। কোনো কেন্দ্রের চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকার যে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে। যদি কোনো কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সত্যিই দেশের জন্য প্রয়োজন, তাহলে তা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে তা খুবই সীমিত হবে বলে আশা করছি।
শুরুতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরপত্রের মাধ্যমে আটটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল। সেই বছর আওয়ামী লীগ সরকার বিনা দরপত্রে ৩২টি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়। দরপত্র এড়াতে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে দুই বছরের জন্য পাস করা হয় জরুরি বিশেষ আইন। পরে আইনটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়। এই আইনের অধীনে ৭২টি রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়। বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় অংশই পেয়েছেন তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার, ইউনাইটেড, এনার্জিপ্যাক অন্যতম। সে সময় বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র পাওয়ার শীর্ষে ছিল সামিট গ্রুপ। সরকার ঘনিষ্ঠ এই গ্রুপ গোপালগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের টানা ছয়বারের এমপি এবং সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খানদের পারিবারিক ব্যবসা। মেয়াদ বাড়ানোর সময় ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ শর্তের কথা বলা হলেও ভিন্ন নামে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন মালিকরা।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১০০ মেগাওয়াট একটি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে বছরে গড়ে শুধু কেন্দ্রভাড়াই দিতে হয় ৯০ কোটি টাকার বেশি। ফলে কোনো বেসরকারি বিদ্যুতকেন্দ্র উৎপাদন না করে বসিয়ে রাখলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কেন্দ্রভাড়া দিতে গিয়ে সরকারের লোকসান বাড়ে। এর বাইরেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অফিস পরিচালনা সংক্রান্ত ব্যয় বাবদ আর অন্তত ৫-১০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে বছর বছর।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত ১৩ বছরে বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় ২৫ হাজার ৩১ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এজন্য পিডিবিকে পরিশোধ করতে হয় এক লাখ ৫৯ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই ছিল ৬৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ছিল পিডিবির ইতিহাসে রেকর্ড। এ সময়ে শীর্ষ ১২টি কোম্পানিকে আট হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে। এত বিশাল ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের পরও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসার জন্য মোট ৪৯ হাজার ৩৯২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আরও ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। এর অধিকাংশই গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
২০০৯ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে ২৮ হাজার ৯৮ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে সচল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও। আর এর খেসারত হিসাবে বেসরকারি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেই চুক্তি অনুযায়ী তথাকথিত ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ বাবদ প্রতিবছর গড়ে ৫-৭ হাজার কোটি টাকা করে গচ্চা দিতে হচ্ছে সরকারকে।
যেহেতু হাইকোর্ট এসব কেন্দ্রকে অবৈধ ঘোষণা করেছে, সেহেতু এগুলো বন্ধে আর কোনো বাধা রইলো না বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ২০০৯-১০ সালের বিদ্যুৎ খাত এবং এখনকার বিদ্যুৎ খাত এক নয়। তখন জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল। চুক্তিগুলো ছিল তিন থেকে পাঁচ বছরের। কিন্তু এরপর এগুলোর সঙ্গে একই শর্তে কেন চুক্তি নবায়ন করা হলো আমি বুঝতে পারছি না। তিনি বলেন, যখন দেখা গেল চাহিদার চেয়ে ৪০-৪৮ ভাগ ক্যাপাসিটি বেশি, তখনই তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল। দেশ এখন একটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন এইগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে ভাড়া দেওয়া অর্থনীতির বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, যদিও আমরা বলে থাকি প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের গড়ে সাড়ে সাত থেকে আট টাকা যায়। কিন্তু বাস্তবে কেন্দ্রভিত্তিক হিসাবের সঙ্গে কুইক রেন্টাল যুক্ত করা হয় তাহলে কোনো কোনো কেন্দ্র থেকে সরকারকে প্রতি কিলোওয়াট আওয়ার বিদ্যুৎ কিনতে হয় ৬০০ টাকায়। এটা হচ্ছে বসিয়ে রেখে ভাড়া দেওয়ার কারণে। আর এর চাপ কিন্তু দেশের মানুষকে নিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পে’ বলা হলেও এসব কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পেছনে বাজেটের একটা বড় পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বিগত সরকার কতিপয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে বছরের পর বছর কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়িয়ে গেছে। আমি বলব, বিগত সরকারের একটি ভ্রান্ত নীতির কারণেই এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র দিনের পর দিন চলেছে। এখন যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিশেষ আইন নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত দিয়েছে এবং হাইকোর্টও এগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করেছে তাই আমরা বলব এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের যেন আর মেয়াদ বাড়ানো না হয়। আর ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়টা নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা উচিত। তবে এক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী অনেক বিনিয়োগকারীর স্বার্থ যেহেতু জড়িত, সেক্ষেত্রে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে।
দেশজুড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ের নামে কয়েক বছর যাবত বিদ্যুৎ উৎপাদনে ‘কৃচ্ছ্রতা’ অভিযান চালায় গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করা আওয়ামী লীগ সরকার। কৃচ্ছ্রতার নামে বেশ কয়েকবার কমানো হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনও। ফলে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জীবন-যাপন করতে হয়েছে মানুষজনকে। কিন্তু তবুও বন্ধ করেনি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। বরং দিনের পর দিন বসিয়ে রেখে পরিশোধ করা হয়েছে এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ। ‘নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ পদ্ধতি অবলম্বনের কথা বলা হলেও ‘মেইনটেনেন্স কস্ট’ বা পরিচালন ব্যয়ের নামেই সরকারের কোষাগার থেকে বেরিয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এখন অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে উল্লেখ করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতটা একটা লুটপাটের খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া মানে হচ্ছে, সেখানে সরকারের অপচয় বা চুরি হচ্ছে। যদি কোনো কেন্দ্র বছরে খুব কম ব্যবহৃত হয় কিংবা যেসব কেন্দ্র একেবারেই ব্যবহৃত হয়নি সেগুলো স্ট্যান্ডবাই হিসেবে থাকে তাহলে এগুলো চালু রাখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে আমরা জানতে পেরেছি, গত অর্থবছরে সামিটের সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে এক হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউনাইটেড গ্রুপের পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, এগুলো পেয়েছে এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। কনফিডেন্স গ্রুপ বিনা দরপত্রে পেয়েছে ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার দিক থেকে গ্রুপটি তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ছয়টি কেন্দ্র বাবদ তারা পেয়েছে ৯৬২ কোটি টাকা। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চম স্থানে আছে বাংলাক্যাটের চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর ভাড়া ৮৮৩ কোটি টাকা। আর ষষ্ঠ সিঙ্গাপুরভিত্তিক সেম্বকর্প, ভাড়া ৭৮৫ কোটি টাকা। সপ্তম যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এপিআর এনার্জি, এর ভাড়া ৬৮০ কোটি টাকা। নবম ডরিন গ্রুপের ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার ভাড়া ৬৫১ কোটি টাকা এবং দশম স্থানে দেশ এনার্জির চার বিদ্যুৎকেন্দ্র ভাড়া পায় ৫১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ডরিন পাওয়ারের মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে ও ঝিনাইদহ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী তাহজীব আলম সিদ্দিকী। দেশ এনার্জি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে দেখা যায়, একটা নির্দিষ্ট মতাদর্শের ব্যবসায়ীদের পকেটেই গেছে এসব হাজার কোটি টাকা। খাতটিতে চলেছে হরিলুট। যা জনগণের পকেট থেকেই গেছে। এখন সময় এসেছে সংস্কারের।
অচল বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল করার তাগিদ ॥ কয়লা সংকট, ব্যবস্থাপনা এবং নানা কারণে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন বন্ধ এবং কমিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে সম্প্রতি। এসব কেন্দ্র দ্রুততম সময়ের মধ্যে চালু করারও নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থে বন্ধ থাকা সব বিদ্যুৎকেন্দ্র যেন উৎপাদনে যেতে পারে, সে বিষয়ে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে ইতোমধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, যেসব কেন্দ্রে কয়লার সংকট রয়েছে, সেসব কেন্দ্রের কয়লা আনা হচ্ছে। কিছু কয়লা আমদানির পাইপলাইনেও রয়েছে।