জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ নজর দিয়েছে অন্তবর্তী সরকার। যেকোনো হাসপাতালে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনে বিদেশেও পাঠানো হচ্ছে গুরুত্বর আহত রোগীদের। কিন্তু তারপরও সুচিকিৎসা মিলছে না দাবিতে গত বুধবার থেকে বিক্ষোভ করেছেন আহত রোগীরা।
ওইদিন দুপুরে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার গাড়িতে উঠে সড়ক অবরোধ করে রাখার পর রাত ৪টার পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন তারা। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলসহ স্বাস্থ্য বিভাগের উর্ধ্বতনদের অনুরোধে তখনকার মতো বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করলেও নিজেদের সুচিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেয় তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৫ উপদেষ্টাসহ স্বাস্থ্য বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৃহস্পতিবার জরুরি বৈঠকে বসে। বৈঠকে আহত সবাইকে পুনর্বাসন করাসহ প্রয়োজনে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বৈঠকে স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান জানান, আজকে আমরা নিশ্চিত করতে চাই এই গণঅভ্যুত্থানে যারা আহত হয়েছেন তাদের স্বল্পমেয়াদি দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন ও চিকিৎসা সেবার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন, এবং বিভিন্ন অংশীদারদের নিয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে আমৃত্যু এই গণঅভ্যুত্থানে আহত সহযোদ্ধাদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং কর্মসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলতে চাই আন্দোলনে আহত যোদ্ধাদের একটি ইউনিক আইডি কার্ড থাকবে এবং এই আইডি কার্ডের মাধ্যমে আন্দোলনে আহতদের সকল সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। এই দেশের সকল সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে তারা আজীবন বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবেন।
এমনকি যে সকল বেসরকারি হাসপাতালের সাথে সরকারের চুক্তি হবে সেখানে তারা বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবেন এবং চিকিৎসা ব্যয়ভার আংশিক সরকার বহন করবে। ইতোমধ্যে আহতরা চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছেন সেগুলা যথাযথ ডকুমেন্টেশন পাওয়ার পর তাদের অর্থ ফেরত দেয়া হবে। যারা পঙ্গুত্ব এবং অন্ধত্ব বরণ করেছেন তাদের প্রতি রাষ্ট্রের সমবেদনা এবং সহানুভূতি। কিন্তু আমরা সেখানে ক্ষান্ত নই।
প্রতিটি অন্ধ মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, তার সামর্থের সঙ্গে মিলিয়ে তাকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে তার পরিবারের আর্থিক সাহায্য ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে জানিয়ে ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন বরণ করেছেন তাদের জন্য যে সকল মেশিন, চিকিৎসা সেবা এবং যে ধরনের যন্ত্রপাতি সহায়তা প্রয়োজন হয় তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
ডা. মো. সায়েদুর রহমান আরো জানান, টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে এ আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন এবং মানসিকভাবে যে ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন তার জন্য তাদের সবাইকে টেলিমেডিসিন নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। এবং যাদের প্রয়োজন হবে তাদের স্ক্রিনিং করে আটটি বিভাগে সাইকো থেরাপি দেয়া হবে। শুধু তাই নয় আগামী ১৭ তারিখের মধ্যে যারা আহত হয়েছেন তাদের জন্য একটি সাপোর্ট সেন্টার তৈরি করা হবে। এবং আহতদের সকল অভিযোগ সেখানে আসবে এবং সেখান থেকে তার নিষ্পত্তি করা হবে। এছাড়া সারাদেশে সকল হাসপাতলে আন্দোলনে আহতদের জন্য শয্যা থাকবে এবং আহতরা ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে সহজেই জানতে পারবেন নিকটস্থ কোন হাসপাতালে শয্যা খালি আছে। তবে যারা আহত হয়েছেন তাদেরকে বিশেষায়িত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে হবে। এজন্য নিটোর, পঙ্গু হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতালসহ ঢাকার বিশেষায়িত সবগুলো হাসপাতালকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সরকারি হাসপাতাল এমনকি বেসরকারি হাসপাতালে যে সকল বিশেষায়িত সেবা আছে সেগুলাকে অন্তর্ভুক্ত করে আহত যোদ্ধাদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হবে। যদি কোন চিকিৎসা দেশে না থাকে এবং বিজ্ঞানসম্মত সম্মতভাবে চিকিৎসক বোর্ড দ্বারা রিকমেন্ড করা হয় তাদেরকে বিদেশের যেখানে চিকিৎসাটা আছে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।
এসব বিষয়ের রূপরেখা আগামী পাঁচ কর্মদিবসের ভেতর সবার সামনে উপস্থিত করা হবে জানিয়ে সায়েদুর রহমান আরও বলেন, এ লিখিত রূপরেখা দেখে টাইমলাইন অনুযায়ী পরে আপনারা বুঝতে পারবেন আমরা যে অঙ্গীকার করেছি সেটা বাস্তবায়নে কাজ হচ্ছে কিনা। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বলতে চাই গণঅভ্যুত্থানে আহত যোদ্ধাদের প্রতি আমরা চির কৃতজ্ঞ। আমরা আপনাদের পাশে আছি।
এসময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে মিলিত হয়েছি এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য নানামুখী প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা সম্পন্ন একজন বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করা হয়েছে। আন্দোলনে আহত অনেকেই হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে আছেন। তাদের ভেতর ট্রমা এবং নানা কারণে বিভিন্ন রকম অনাস্থা তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রের অনেকগুলো সমস্যা আমাদের একসঙ্গে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তাই আমরা বারবার এটা নিশ্চিত করতে চাই আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে আমাদের সর্বোচ্চ রকম অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এই উদ্যোগগুলো আমাদের আগে থেকেই ছিল এবং কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই যে বিশেষ সহকারি নিয়োগ এটা কিন্তু এ বিভিন্ন রকম দাবির আগেই করা হয়েছে। কাল (বুধবার) এক ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিত হয়েছে। আমরা স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনাগুলো দ্রুতই বাস্তবায়ন করতে চাই এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো দ্রুত দৃশ্যমান একটা পর্যায়ে নিয়ে আসতে চাই।
বৈঠকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, ডাক টৈলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, সমাজ কল্যাণ উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফরসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এসময় জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহতদের একটি প্রতিনিধিদলও উপস্থিত ছিলেন।
ফুয়াদ