.
‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের আশ্রয়ে সাহিত্যের আকাশে জ্বলে উঠেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়েছিল মধ্যবিত্ত জীবনের চালচিত্র আঁকা গ্রন্থটি। সহজ-সরল ভাষার সঙ্গে সংলাপধর্মী উপন্যাসটি সহজেই আকৃষ্ট করেছিল সাহিত্যানুরাগীদের মন। পরের গল্পটি শুধুই এগিয়ে যাওয়ার। টানা চারটি দশক আপন সৃষ্টিশীলতায় মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন পাঠককে। সেই সূত্রে ধারণ করেছেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও জননন্দিত কথাসাহিত্যিকের পরিচয়টি। কীর্তিমান এই মানুষটি একইসঙ্গে হেঁটেছেন সাহিত্য ও শিল্পের বর্ণময় পথে। সরল রেখার মতোই সহজ ছিল তাঁর লেখার ভাষা। গল্প ও উপন্যাসের উদ্দীপক কিংবা রহস্যময় বুনটে বিভোর করে রেখেছিলেন পাঠককে। এদেশের সাহিত্যভুবনে ভারতীয় লেখকদের একচেটিয়া আধিপত্যকে ম্লান করে আপন লেখনীর অনবদ্যতায় গড়ে দিয়েছেন সৃজনশীল প্রকাশনাশিল্পের ভিত্তিভূমি। গল্প-উপন্যাসের সমান্তরালে বিচিত্র বিষয়ের নাটক কিংবা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিল্পরসিকদের দিয়েছেন বিশুদ্ধ বিনোদনের খোরাক। আজ ১৩ নভেম্বর (বুধবার) বাংলা সাহিত্যের এই জননন্দিত লেখক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকারের ৭৭তম জন্মদিন ও ৭৬তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৪৮ সালের এই দিনে তিনি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে নানা বাড়িতে জš§গ্রহণ করেন। এই কথাশিল্পীর জন্মদিনে বিশেষ প্রবন্ধ, নিবন্ধসহ নানা প্রতিবেদন ছাপে পত্রিকাগুলো। টিভি চ্যানেলগুলোর পর্দায় দিনভর দেখা যাবে তাঁর নির্মিত নাটক, সিনেমাসহ নানা অনুষ্ঠান।
মঙ্গলবার রাত ১২টার পর লেখকের ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’ ফ্ল্যাটে কাটা হয়েছে জন্মদিনের কেক। হুমায়ূনকে স্মরণ করে দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে কেক কেটেছেন লেখকের সহধর্মিণী মেহের আফরোজ শাওন। এ ছাড়া আজ ভোরে শাওন তার দুই ছেলেকে নিয়ে হুমায়ূনের স্মৃতিধন্য গাজীপুরের পিরুজালী গ্রামের নূহাশ পল্লীতে লেখকের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করার কথা রয়েছে। মিলাদ মাহফিলের পাশাপাশি এতিমদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করা হবে।
এ ছাড়া লেখকের জন্মদিন উপলক্ষে আজ বিকেলে হুমায়ূন আহমেদ নিবেদিত আলোচনা সভার আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি।
হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন। এই লেখকের রতœগর্ভা জননীর নাম আয়েশা ফয়েজ।
পাঠক বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। উপন্যাসে নিজের প্রতিভার বিস্তার ঘটলেও তার শুরুটা ছিল কবিতা দিয়ে। এরপর নাটক, শিশুসাহিত্য, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর। হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর জনকও বটে। ১৯৭২ সালে প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের পরপরই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। উপন্যাস ও নাটকে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো বিশেষ করে ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’, ‘শুভ্র’ তরুণ-তরুণীদের কাছে হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। বলা হয়, তাঁর লেখা পছন্দ করেন না এমন মানুষও তাঁর নতুন লেখাটি গোপনে পড়ে ফেলেন। দেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, যারা তাঁর অন্তত একটি নাটক দেখেনি কিংবা তাঁর কোনো বই পড়েনি।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাসের সংখ্যা দুই শতাধিক। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, মন্দ্রসপ্তক, দূরে কোথায়, সৌরভ, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরীপুর জংশন, নৃপতি, অমানুষ, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচীনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, বৃষ্টি ও মেঘমালা, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, জোছনা ও জননীর গল্প, দেয়াল, বাদশাহ নামদার প্রভৃতি। রচনা ও পরিচালনা করেছেন বহু একক ও ধারাবাহিক নাটক। পরিচালনা করেছেন চলচ্চিত্রও। তাঁর সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’র জন্য জয় করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
হুমায়ূন আহমেদের দীর্ঘ চার দশকের সাহিত্যজীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেÑ একুশে পদক (১৯৯৪), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) ইত্যাদি। দেশের বাইরেও সম্মানিত হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। জাপানের ‘এনএইচকে’ টেলিভিশন তাঁকে নিয়ে ‘হু ইস হু ইন এশিয়া’ শিরোনামে ১৫ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি প্রচার করে।
২০১২ সালে ১৯ জুলাই বর্ষার রাতে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ক্যান্সার আক্রান্ত হুমায়ূন আহমেদ পাড়ি জমান অদেখার ভুবনে। আকাশচুম্বী জনপ্রিয় এ লেখকের মৃত্যুতে সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় হুমায়ূন আহমেদের মরদেহ। বিমানবন্দর থেকে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে। সেখানে লাখো মানুষের অশ্রুসিক্ত ফুলেল ভালোবাসায় সিক্ত হন তিনি। এরপর লেখককে সমাহিত করা হয় তাঁর গড়ে তোলা নন্দনকানন নূহাশ পল্লীর লিচুতলায়। সেখানেই চিরঘুমে শায়িত হয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ।