ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১

বাহাসে ফিকে হয়ে আসে গ্রাফিতি: রক্তই সমাধান!

প্রকাশিত: ২২:৩২, ১১ নভেম্বর ২০২৪

বাহাসে ফিকে হয়ে আসে গ্রাফিতি: রক্তই সমাধান!

কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো কেউ কথা রাখেনি ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিলো শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে তারপর কত চন্দ্রভুক অমবস্যা এসে চলে গেল, কিন্তু সেই বোষ্টুমি আর এলো না পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি ।

 

 

 

সুনীলের অপেক্ষাটা ছিল তেত্রিশ বছরের।কিন্তু আমাদের অপেক্ষাটা ১৫ বছরের।আবার সেই শুক্লা দ্বাদশীর দিন বোষ্টুমি আসুক দিক আমাদের মুক্তির স্বাদ।যে স্বাদ গ্রহণ করতে কারাগারে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিয়েছে বিপ্লবীরা।দিন যায় মাস যায় সেই নতুন ভোর,নতুন সকাল,নতুন সূর্য আর উঠে না।অপেক্ষার প্রহর ও শেষ হয় না বিপ্লবীর।আর বুঝি আসবে না বোষ্টুমি,শোনাবে না মুক্তির গান।

অবশেষে এলো সেই বোষ্টুমি।এবার আর একা নয়,হাজারো  লাখো  বোষ্টুমি।হাতে প্লেকার্ড ,মাথায় রক্ত রাঙ্গা লাল সবুজের বিপ্লবী পতাকা।চোখে মুখ তার রক্তিম আভা,বজ্রমুষ্ঠি তার হাত,চাহনিতে তার অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ।এসেই ঘোষণা দিল বোষ্টমি,অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন, কান্ডারী আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।

অবশেষে  ঘুম ভাঙ্গল বিপ্লবীর।কিন্তু পায়ে তার তখনো শিকলের বেড়ি।এ শিকল মনের দাসত্বের শিকল।এ শিকল পরাধীনতার শিকল।এ শিকল বৈষম্যের শিকল।বোষ্টুমি আবার হুংকার দিল, গাজনের বাজনা কে মালিক কে সে রাজা কে দেয় সাজা মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে হা হা হা পায় যে হাসি ভগবান পরবে ফাঁসি সর্বনাশী শিখায় এ হীন তথ্য কে রে ॥

অবশেষে বিপ্লবীর ঘুম ভাঙল,জেগেই হুংকার দিল,আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই।বিপ্লবীর এক হুংকারে ,অসুর পালাল অন্য রাজ্যে।জয় হল সত্য সুন্দরের।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫ই আগস্ট ছাত্র জনতার প্রবল জনরোষে সেদিন সামরিক হেলিকাপ্টারযোগে  আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে আত্নরক্ষা করেন।

রক্তাক্ত জুলাইয়ের সেই স্মৃতি,শাসকের বুলেটের দাগ এখনো রাজপথ থেকে মুছে যায় নি।ঢাকার দেয়ালে এখনো জীবন্ত স্মৃতি হয়ে আছে রক্তাক্ত জুলাই আগস্ট।দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিগুলো ফিকে হয়ে আসছে। মলিন হয়ে আসছে হৃদয় নিংড়ে বেরিয়ে আসা রঙের আঁচড়গুলো।

কে হিন্দু কেবা মুসলিম,কে বাম কে ডান সব বিভেদ ভুলে গিয়ে বিপ্লবী ছাত্র জনতার স্রোত এসে মিশেছিল ঢাকার রাজপথে। এমন জাতীয় ঐক্য শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন, মনে হয়, সারা  পৃথিবীতেই বিরল।

লাখো জনতার এই অভ্যুত্থানকে মানুষ তুলনা করেছেন আরব বসন্তের সঙ্গে।অনেকেই আশঙ্কা করেছেন আরব বসন্তের মতোই আমাদের অর্জন হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।  আরব বসন্ত থেকে শিক্ষা নিলে মিসর কিংবা সুদানের মতো দেশের পরিণতি এড়িয়ে অন্তত শ্রীলঙ্কার পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

মিসরে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে তাহরির স্কয়ারে সম্মিলিত জনতা যখন স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন এক মিসরের, যেখানে থাকবে সাম্যের গান, গণতন্ত্র পাবে মুক্তি, মানুষ ফিরে  পাবে তার ন্যায্য হিস্যা । বছর না যেতেই সে দেশে নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন মুসলিম ব্রাদারহুড–সমর্থিত মোহাম্মদ মুরসি। দেখা দেয়,জাতীয় একতার বদলে অভ্যুত্থানে সম্মিলিত শক্তিগুলোর মধ্যে বিবাদগুলো প্রকাশ্যে আসতে থাকে, ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত।

৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আফ্রিকার আরেক দেশ সুদানের রাষ্ট্রপতি ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান হয় ২০১৮ সালে।সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও অভ্যুত্থান শক্তিগুলোর পরষ্পর কোন্দলে এখন সুদানে সামরিক বাহিনী আর মিলিশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ নিত্য দিনের ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে হাজারো নিরীহ মানুষ।

২০২২ সালের জুলাইয়ে সীমাহীন দুর্নীতি আর অসহনীয় দ্রব্যমূল্য অভিযোগে শ্রীলঙ্কার মানুষকে তাদের বিপ্লবী চেতনা রাস্তায় নিয়ে আসে।দেশটির  তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে ‘গোটা গো হোম’ স্লোগান তুলে দেশ থেকে হটিয়ে দেয় জনতা। একদিকে চীন, অন্যদিকে ভারতের চাপ সামলে চলতে হয় এই দ্বীপরাষ্ট্রকে। তারপরও সে দেশের তরুণ প্রজন্ম সব বিভেদকে দূরে ঠেলে গণতন্ত্রের দিকে হাঁটছে।

দেশের প্রশ্নে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে এবং ন্যূনতম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে দেশটির তারুণ্য এখনো এককাট্টা। শ্রীলঙ্কায় দ্রব্যমূল্য এখন কমতির দিকে, নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। নতুন আশায় বুক বাঁধছে দেশটির জনগণ।

জুলাই বিপ্লবে যারা জীবন দিয়েছেন তারা ও আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন আগামীর সুখী সমৃদ্ধ বৈষম্যহীন বাংলাদেশের।স্বপ্ন আমাদের আকাশ ছোঁয়া।পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিবাদী শক্তি হয়তো রাজপথে আর আমাদের উদ্ধত পিস্তল হাতে তাড়া করতে পারছে না, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়, অনেক বেশি  সংগঠিত।

যাঁরা জুলাইয়ে এক দাবিতে একমত হয়েছিলেন, তাঁরা আজ নানা দাবিতে বিভক্ত। কেউ জাতীয়তাবাদী, কেউ সমাজতন্ত্রী, কেউবা ইসলামি রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নিজেদের মতাদর্শে বাংলাদেশকে ঢেলে সাজাবার চেষ্টায় ব্যস্ত।

মানুষ মনে করছে অতীতের স্বৈচার পতনের পরও দলগুলোর ক্ষমতা যাওয়ার আকাঙ্খা থেকেই যায় কিন্তু সেই আকাঙ্খার ক্ষমতাকে ফলাতে হবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের মাধ্যমে।তারা আরো মনে করছেন,অতীত থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যেতে হবে।

জুলায়ের দেয়াল চিত্রের গ্রাফিতিগুলো আমাদের কালের স্বাক্ষী।এগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়,এ বিপ্লব সামান্য কিছু নয়।এ বিপ্লবের পিছে জড়িয়ে আছে হাজারো মা, বোনের, সন্তান,ভাই হারানোর আত্নত্যাগ।এ গ্রাফিতি হয়তো দেয়ালে মুছে যাবে কিন্তু মন শিল্পীর আছড়ে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে আমাদের জাতীয় চেতনায়।

ফুয়াদ

×