.
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সরকার পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো এজেন্ডা নেই। কোনো ব্যক্তিগত এজেন্ডা নেই, আমাদের এজেন্ডা হলো- দেশের স্বার্থ। আমরা চেষ্টা করছি এটা নিয়ে। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বললেও দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা সেভাবে ডিজিটালাইজড হতে পারিনি। এখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না এলে কোনো কিছুই সম্ভব নয়।
সোমবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও-একটি দৈনিক পত্রিকা আয়োজিত তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ‘বৈষম্য, আর্থিক অপরাধ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির নিরাময়’ শীর্ষক সেমিনারে এ কথা বলেন তিনি।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, আমাদের অনেক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা তিনটা পরিকল্পনা নিয়েছি যেটার মধ্যে রয়েছে মধ্য, শর্ট ও লং-টার্ম। এর মধ্যে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারব। দীর্ঘমেয়াদিগুলো নির্বাচিত সরকার এসে বাস্তবায়ন করবে। আমরা মধ্য ও শর্ট টার্ম এমন কিছু করব, অন্য সরকার এসে যেন সেটা পারসু করে, সেভাবে কাজ করে যায়। এখন আয় বৈষম্য থেকে সম্পদের বৈষম্য বেশি। অধিকাংশ সেবা আমরা অটোমেটেড করার চেষ্টা করছি। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বললেও দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা সেভাবে ডিজিটালাইজড হতে পারিনি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না এলে কোনো কিছুই সম্ভব নয়।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমাদের সিদ্ধান্তগুলো এখন দ্রুত হয়। এ সিদ্ধান্ত দ্রুত হওয়া মানে স্লিপশট ডিসিশন নয়। ভাবনা-চিন্তা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছি আমরা। দ্রুত আমরা খাদ্যদ্রব্যের দাম, শুল্ক কমানোর চেষ্টা করি। এসবের সিদ্ধান্ত নিতে এর আগে সময় লাগত। আবার কিছু রাজনৈতিক ইম্পেরেটিভ থাকে, সেটার জন্য করা সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, একটা ফুটপ্রিন্ট আমরা রেখে যেতে চাই। যেটা স্বল্প সময়ে বা মধ্যবর্তী সময়ে রেখে যাব, ভবিষ্যতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তারা যাতে তা বাস্তবায়ন করে। ফুটপ্রিন্ট যেটা রেখে যাব সেটায় যেন জনগণ সন্তুষ্ট হয়। তখন রাজনৈতিক সরকারকে জনগণ প্রেশার দেবে, আপনারা এটা করছেন না কেন ইত্যাদি?
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বেক্সিমকো কয়েক মাস ধরে তাদের শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারছিল না। সরকার অর্থ দিয়ে তাদের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করছে। এখন গ্রুপটিতে রিসিভার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাতে গ্রুপটি (বেক্সিমকো) সচল করা যায়। আর কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। দুর্বল ব্যাংকে তারল্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আপনারা গণমাধ্যমে দেখেছেন বেক্সিমকোয় রিসিভার নিয়োগ করা হয়েছে। কোনো বিজনেস প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়নি। বেক্সিমকো রিসিভার দেওয়া মানে বন্ধ নয়, বরং এটা সচল করা হচ্ছে। কারণ, গত কয়েক মাস বেক্সিমকোর বেতন-ভাতা সরকার থেকে দেওয়া হয়েছে? যে কোনো কোম্পানি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। এটা করা হয়েছে বেক্সিমকো সচল করার জন্য। তারা কয়েক মাস শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারত না। এখন রিসিভার বসানোর মাধ্যমে সচল করা হবে। একই সঙ্গে বেক্সিমকোর রপ্তানির টাকা যেন বেহাত না হয়। দেশের টাকা যেন দেশেই ফিরে আসে দেখতে হবে।
ব্যাংক নিয়ে তিনি বলেন, বিগত সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের ব্যাংক খাত। তবে দ্রুত সব সমাধান হবে না। আমাদের ব্যাংক খাতে নাজুক অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। দ্রুত সংস্কার বা সমাধান চাইলে আমার চাকরি ছেড়ে দিতে হবে। কারণ এক ব্যাংকের ২৭ হাজার কোটি টাকার এসেট এক পরিবার ২৩ হাজার কোটি নিয়েছে। আমার হাতে ম্যাজিক নেই। তবে কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না এটা বলতে পারি। দুর্বল ব্যাংকে টাকা তুলতে পারছে না এ কারণে তাদের তারল্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, সব সমাধানও হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, আমরা শ্রীলঙ্কা হয়ে যাইনি, আমাদের গ্রোথ নেগেটিভ হয়নি। আমরা ঠিক করছি বিনিময় হার, বিনিয়োগ পরিবেশ। আমরা আশাবাদী বিনিয়োগ আসবে, আমরা চাই বিনিয়োগ আসুক। অর্থপাচার নিয়ে তিনি বলেন, দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে দেশ থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে, এটা ফিরে পাওয়া কঠিন ছিল। তবে জাল ফেলা হয়েছে এখন গোটানো বাকি। এরই মধ্যে আমরা দেশ ও দেশের বাইরে যোগাযোগ করেছি। আমাদের সহযোগিতার জন্য চলতি সপ্তাহে আমেরিকার প্রতিনিধি আসছে, যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি আসবে, বিশ্বব্যাংক আসবে, সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও কথা হবে।
তিনি বলেন, আমরা চাই না কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা শিল্প বন্ধ হয়ে যাক। কারণ সেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। আবার কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হিসাবও জব্দ করা হয়নি, হবেও না। ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। ঢাকায় টোটাল ব্যাংকিংয়ের ৫৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৭ শতাংশ বাকিটা অন্য জায়গা। আমরা এটাকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। আমাদের এজেন্ট ব্যাংক বড় কাজ করছে, এমএফএস সেবা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
কয়েকটি ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। কিন্তু তাদের নগদ সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে গত তিন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে কোনো নগদ সহায়তা দেওয়া হয়নি। কারণ ম্যাক্রো ইকোনমি স্ট্যাবল রাখতে হবে। এটা স্ট্যাবল না হলে কোনো বিনিয়োগ হবে না। এজন্য ব্যবসায়ীদের ধৈর্য ধরতে হবে। আমাদের উদ্দেশ্য যারা ব্যাংকের টাকা মেরেছে তারা ব্যাংকের সঙ্গে থেকে টাকা ফেরত দেয়। বাইরে যে টাকা চলে গেছে সেসব কীভাবে আইনগত প্রক্রিয়ায় ফেরত আনা যায় সেই চেষ্টা চলছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে কোনো দুর্ভিক্ষ হবে না। আমরা কি শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছি, না। আমাদের গ্রোথ কমেনি। যে কোনো পলিসি ইমপ্লিমেন্ট করলেও মূল্যস্ফীতি এক বছরের আগে কোনো দেশেই কমে না। চার মাস পার করছি আমাকে আরও ৮ মাস সময় দিতে হবে। আমরা শুধু মুদ্রানীতির ওপর নির্ভর করছি না। সব প্রয়োজনীয় পণ্য এলসি খোলা, শুল্ক শিথিল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ফরেন এক্সচেঞ্জ শর্টেজ এখন নেই। আমি মনে করি, সাপ্লাই সাইডে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংক রেজ্যুলেশন অ্যাক্ট নিয়ে আসতে চাচ্ছি। ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর পাকিস্তানের থেকেও দুর্বল। এটা ঠিক হতে ২-৩ বছর সময় লাগবে।
বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ, বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সেমিনারে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) কান্ট্রি ডিরেক্টর হোয়ে ইউন জিয়ং উপস্থিত ছিলেন।