.
করোনা মহামারির সময় থেকেই আলোচনায় ছিল দেশের স্বাস্থ্য খাত। ভাইরাসটির টিকা আমদানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাসপাতালের সরঞ্জামাদি কেনাকাটায় সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে একের পর এক। অভিযোগ ওঠে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিকের নেতৃত্বে চলে এই দুর্নীতির কর্মযজ্ঞ। এরই মধ্যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন শেষে গঠন হয় নতুন সরকার। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ডা. সামন্ত লাল সেন। সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত আর পারেননি। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব হারান তিনিও। এমন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন বাংলাদেশ তৈরির লক্ষ্যে কাজ শুরু করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর-পরিদপ্তর। অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে বিবেচিত স্বাস্থ্য খাতের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান নূরজাহান বেগম। পরিবর্তন আসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদেও। অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনের স্থলে নতুন মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক ডা. আবু জাফর। নানান সংকটের মুখে দায়িত্ব নিলেও নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকা বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বললেন, স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করাই তার প্রধান লক্ষ্য। প্রতিটা মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করবেন তিনি। এমনকি দীর্ঘদিনের বঞ্চনার শিকার চিকিৎসকদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেও কাজ করবেন।
জনকণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যেহেতু স্বাস্থ্য ক্যাডার একটি বড় খাত, তাই এক্ষেত্রে একটু সময় লাগবে। সবার সহযোগিতা পেলে দুর্নীতিমুক্ত, শোষণমুক্ত স্বাস্থ্য খাত গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে সবাইকে মিলেমিশে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে ছাত্র আন্দোলনে আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা। আর স্বাস্থ্য বিভাগ এই কাজটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে করছে জানিয়ে তিনি বলেন, আন্দোলনে আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ছাত্র-জনতা। তাদের সবার একটা তালিকা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেতৃত্বে এই তালিকা তৈরি করতে ছাত্র সমন্বয়করাও কাজ করছেন। আশা করছি, প্রত্যেক আহত রোগী সুচিকিৎসা পাবেন। যাদের দেশে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয় তাদের দেশের বাইরে চিকিৎসা দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। পরিবর্তিত একটা পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পেয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৪-১৫ বছরের অনিয়ম-জঞ্জাল না সরাতে পারলে কাজ করতে পারব না। চারপাশে সমমনা লোক দরকার। যারা আমাদের কাজটাকে সহজ করে দেবে। সবার সহযোগিতা পেলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। তিনি বলেন, প্রশাসনে যারা আগে ছিলেন তাদের বেশিরভাগই ফ্যাসিস্ট সরকারের নিয়োগকৃত। তাদের সরাতে না পারলে কাজ করা কঠিন। বেশ কিছু দুর্নীতি রয়েছে যা খুব দ্রুততম সময়ে সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কাজ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে তারা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।
আগের সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলো কি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের অপারেশন প্ল্যান যা ছিল সব বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আর কোনো অপারেশন প্ল্যান নেই। নতুন করে কবে নাগাদ কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে কি না তা এখনি বলা যাচ্ছে না।
সাম্প্রতিক দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ঊর্ধ্বমুখী। এ রোগের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য বিভাগ কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালের পর্যাপ্ত সক্ষমতা আছে। সেখানে সম্প্রতি ১৬ চিকিৎসককে অধিদপ্তর থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সিভিল সার্জন অফিস থেকে আরও ১০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। অন্যান্য হাসপাতাল থেকেও যদি কেউ চিকিৎসক চায় তাহলে দেওয়া হবে। রোগী আরও বাড়লে প্রয়োজনে আরও কয়েকটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড করা হবে। তবে আপনারা জানেন, মুºা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ইতোমধ্যে ডেডিকেটেড ওয়ার্ড রয়েছে। প্রয়োজনীয় জনবল যদি সংকট থাকে অধিদপ্তরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে শুধু স্বাস্থ্য বিভাগ বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একা কাজ করলে হবে না। এডিস মশার উৎসস্থল ধ্বংস করতে সিটি করপোরেশনগুলোর তৎপরতা যেমন বাড়াতে হবে তেমনি সাধারণ মানুষজনকেও সচেতন হতে হবে। নিজের বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাড়িতে যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গড়ে ওঠা সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি ভুতুড়ে হাসপাতাল হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে করা এই প্রকল্পটি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে আসলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে। তবে আমাদের কাছে ছাত্র সমন্বয়করা এসেছিলেন এটিকে ছাত্রদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায় কি না সে বিষয়ে আলোচনা করতে। আমরা বলেছি প্রয়োজন হলে তা করা হবে।
দীর্ঘদিনের পদবঞ্চিতরা প্রায় প্রতিদিন অধিদপ্তরের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে। তাদের জন্য কি করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বৈরাচার সরকারের শাসনামলে বৈষম্যের শিকার চিকিৎসকরাই পদায়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন। নানা সমস্যায় জর্জরিত স্বাস্থ্য খাত। এ খাত এমন পর্যায়ে এসেছে যে এখন সংস্কার প্রায় অসম্ভব। এটাকে ভেঙে পুনরায় ঢেলে সাজাতে হবে। আমি কিছুদিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি, আমি চেষ্টা করব স্বৈরাচার সরকারের শাসনামলে বৈষম্যের শিকার চিকিৎসকরাই যেন পদায়নে অগ্রাধিকার পায়।
গত ১৫ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফরকে। এর আগে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন তার দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে বদলির আদেশ প্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের পার-১ শাখায় বদলি করা হয়েছে। পরবর্তী উপযুক্ত পদায়নের জন্য তাকে এই শাখায় ন্যস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।