.
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হামলায় পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কোনো আশার আলো নেই। জান্তা বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে ২০১৭ সালের পর গত চার বছরে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। সম্প্রতি গত দুই মাসে বিভিন্ন পথে বাংলাদেশে ঢুকেছে আরও ৪০ হাজার রোহিঙ্গা। প্রতিদিনই কিছু কিছু করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে নতুন করে ঢুকলেও জাতিসংঘসহ শক্তিধর দেশগুলো এ সংকট সমাধানের তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি বা মিয়ানমারের ওপর কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি। ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পরিবর্তে দিন দিন আরও তীব্র হচ্ছে।
গত ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট নতুন রূপ নেওয়ায় বাংলাদেশসহ এই অঞ্চল ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। মাদক চোরাচালান, ডাকাতিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর সেখানে মানবিক সংকটের পাশাপাশি সামাজিক সংকটও অনুমান করেছিল জাতিসংঘ। কারণ কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বাসিন্দারা আগে কখনোই এত সুযোগ-সুবিধা দেখেনি যা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য আসছে। রোহিঙ্গারা আসার পর সেখানে প্রচুর অর্থ ও সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে দেশী-বিদেশী সংস্থাগুলো। ফলে শুরুতে স্থানীয় লোকজন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে খাবার ও স্থান ভাগাভাগি করে নিলেও দিন দিন সেখানকার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে, যা থেকে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হয়েছে। এরই মধ্যে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বেশ কিছু সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে সেখানে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থ বরাদ্দ করা শুরু করেছে জাতিসংঘ।
এ ছাড়া ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। দেশের বেশ কিছু স্থান থেকে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে আবারও কক্সবাজারের ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে। আর সেইসঙ্গে রোহিঙ্গারা অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশী পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।
কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার স্থান করে দেওয়ায় সেখানকার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ক্ষতি হয়েছে, যা পূরণ হতে কয়েক দশক লেগে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। শুরুতে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী মর্যাদা দিতে চাপ ছিল। এখন আর সেই চাপ নেই। তবে জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশন অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য তীব্র চাপ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে চীন, রাশিয়া ও ভারতের অবস্থান প্রত্যাবাসনে বাধা সৃষ্টি করছে। আর দাতা গোষ্ঠীগুলোও চায় না সঠিক এবং টেকসই প্রত্যাবাসন ছাড়া তারা মিয়ানমারে ফিরে যাক।
বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়লেও এ বিষয়ে মিয়ানমারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারেনি জাতিসংঘ ও বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো। উল্টো চীন ও রাশিয়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট তৈরি হওয়ার পর দ্বিপক্ষীয়ভাবে সংকট নিরসনে তড়িঘড়ি করে প্রত্যাবাসন-সংক্রান্ত ত্রুটিপূর্ণ চুক্তি করে বাংলাদেশ। সেই চুক্তি অনুযায়ী চীনের উপস্থিতিতে কয়েকবার প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করলেও সেটি সফল হয়নি। এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবাসিত হয়নি। আর মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের পর সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নেয়। এর পর আর মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি বাংলাদেশের পক্ষে। এমনকি চীনের নেতৃত্বে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটিতেও সাড়া দেয়নি মিয়ানমার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মোহসিন মনে করেন, সমস্যাটি আন্তর্জাতিক, দ্বিপক্ষীয় নয়। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে চীন, রাশিয়া ও ভারতের অবস্থান প্রত্যাবাসনে বাধা সৃষ্টি করছে। সেইসঙ্গে মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা তো রয়েছে। বাংলাদেশ শুরুতে এ ক্ষেত্রে যা করেছে, এর থেকে বেশি কিছু করার ছিল না।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা বললেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে আমাদের চীন, জাপান, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশগুলোকে বোঝাতে হবে। কারণ, মিয়ানমার স্থিতিশীল না হলে সেখানে দেশগুলোর বিনিয়োগও নিরাপদ নয়। আর মিয়ানমার স্থিতিশীল হওয়া শুরু করবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের মধ্য দিয়ে।’ তিনি বলেন, বর্তমানে দুটি আন্তর্জাতিক আদালত আইসিসি এবং আইসিজেতে এ বিষয়ে মামলা চলছে। এখান থেকে একটা রায় পাওয়া গেলে প্রত্যাবাসনে একটি গতি আসবে।’ এ ছাড়াও আরও বিভিন্ন উপাদান রয়েছে তার মাধ্যমেও প্রত্যাবাসনে গতি আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি।