.
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর ডিজিটালাইজেশনে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে জোরদার করা হচ্ছে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে এর মধ্যেই প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ও ওয়েবসাইট তৈরি থেকে শুরু করে সব ধরনের কারিগরি প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে এনবিআর। গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে অনলাইন রিটার্ন দাখিল সিস্টেমকে করদাতাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান বলেন, ‘আমরা এনবিআরের কমপ্রিহেনসিভ ডিজিটালাইজেশন প্ল্যান করছি। এ লক্ষ্যে ভ্যাট, ইনকাম ট্যাক্স, কাস্টমসসহ এনবিআরের অধীনে সব কার্যক্রম আমরা অটোমেশনের আওতায় আনব। ধীরে ধীরে শুরু হলেও দ্রুততম সময়ে এই ডিজিটালাইজেশনের কাজ শেষ করব। সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি।’
এদিকে সহজ পদ্ধতিতে খুব কম সময়ে ঘরে বসেই রিটার্ন জমা দেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় খুশি করদাতারাও। চালু হওয়ার পর থেকেই করদাতাদের থেকে বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছে। এনবিআরের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ সেপ্টেম্বর চালুর পর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন ১ লাখ ৬৭ হাজার করদাতা।
এর আগে গত জুন মাসে চালু হওয়া নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী করদাতাদের আয়কে সাতটি খাতে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, চাকরি থেকে আয়, ভাড়া থেকে আয়, কৃষি থেকে আয়, ব্যবসা থেকে আয়, মূলধনী আয়, আর্থিক পরিসম্পদ হতে আয় এবং অন্যান্য উৎস থেকে আয়। সব খাতের আয় যোগ করে মোট আয় নির্ধারণ করতে হবে এবং তার ওপর কর প্রযোজ্য হবে।
আয়কর আইন অনুযায়ী ব্যক্তি খাতের সর্বনিম্ন করমুক্ত আয়সীমা হচ্ছে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার নিচে আয় হলে তাকে কর দিতে হবে না। তবে এর পরের ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। এর পরের ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর কর দিতে হবে ১০ শতাংশ। পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর কর দিতে হবে ১৫ শতাংশ। এর পরের ৫ লাখ পর্যন্ত কর দিতে হবে ২০ শতাংশ হারে। অবশিষ্ট যা মোট আয় থাকবে সেটার ওপর দিতে হবে ২৫ শতাংশ হারে কর।
তবে নারী এবং ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সীদের জন্য করমুক্ত ব্যক্তি-আয়ের সীমা ৪ লাখ টাকা। তৃতীয় লিঙ্গ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। অপরদিকে গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা।
ই-রিটার্ন কি ॥ একজন করদাতা কর্তৃক সরকারকে কর দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় আয়কর রিটার্ন দাখিলের মাধ্যমে। আয়কর কর্তৃপক্ষের কাছে একজন করদাতার বার্ষিক আয়, ব্যয় ও সম্পদের তথ্যাবলি নির্ধারিত ফরমে উপস্থাপন হয় আয়কর রিটার্নের মাধ্যমে।
দেশের আয়কর আইন অনুযায়ী, স্বাভাবিক ব্যক্তি-করদাতার রিটার্নে সব ধরনের আয়ের বিবরণী, দেশের এবং বাংলাদেশের বাইরে অবস্থিত সব ধরনের পরিসম্পদ ও দায়ের বিবরণী এবং ক্ষেত্রমতো, জীবনযাপন সংশ্লিষ্ট সব ধরনের ব্যয়ের বিবরণী সংবলিত হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ফরমে রিটার্ন দাখিল করতে হয়। অতীতের মতো ম্যানুয়াল পদ্ধতির পাশাপাশি অনলাইনেও দাখিল করা যাবে এই রিটার্ন। একে বলা হচ্ছে ই-রিটার্ন। তবে কর আহরণ পদ্ধতিকে ডিজিটাল করতে বর্তমানে ম্যানুয়াল পদ্ধতির থেকে ই-রিটার্ন দাখিল কার্যক্রমকে উৎসাহিত করছে এনবিআর কর্তৃপক্ষ। এর অংশ হিসেবে করদাতাদের জন্য সহজসাধ্য করা হয়েছে ই রিটার্ন দেওয়ার পদ্ধতি।
যেভাবে অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে ॥ অনলাইনে রিটার্ন জমার আগে প্রথমে করদাতাকে নিবন্ধন নিতে হবে। নিবন্ধন নিতে করদাতার নিজের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ও বায়োমেট্রিক করা মোবাইল নম্বর লাগবে। করদাতার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে বায়োমেট্রিক রেজিস্টার্ড কি না তা যাচাই করতে *১৬০০১# নম্বরে ডায়াল করতে হবে। কর শনাক্তকরণ নম্বর ও বায়োমেট্রিক মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করে এই পদ্ধতিতে যঃঃঢ়ং://বঃধীহনৎ.মড়া.নফ ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ই রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে।
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন তথা ই-রিটার্ন দিতে করদাতাকে কোনো কাগজপত্র আপলোড করতে বা জমা দিতে হবে না। শুধু ওই সব দলিলের তথ্য দিলেই হবে। যেমন, সনাতন পদ্ধতিতে চাকরিজীবীদের আয়ের বা বেতন-ভাতার প্রমাণপত্র হিসেবে ব্যাংক হিসাবের এক বছরের লেনদেন বিবরণী (স্টেটমেন্ট) জমা দিলেই চলবে। আগের বছরের ১ জুলাই থেকে পরের বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত (অর্থবছর) সময়ের ব্যাংক হিসাবের স্থিতি, সুদের তথ্য ও ব্যাংক হিসাবের নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য দিতে হবে।
যাদের ই-রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ॥ কয়েকটি খাতের পেশাজীবীদের অনলাইনে রিটার্ন জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ৪ সিটি করপোরেশনে অবস্থিত আয়কর সার্কেলের অধিভুক্ত সরকারি কর্মচারীরা। পাশাপাশি সারা দেশের তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জন্যও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ই-রিটার্ন। সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দেশের বিভিন্ন মোবাইল টেলিকম সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি, ম্যারিকো বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ, বাটা শু কোম্পানি (বাংলাদেশ) ও নেস্লে বাংলাদেশের কর্মীদের জন্যও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ই-রিটার্ন জমা দেয়ার পদ্ধতি।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের জন্য ই-রিটার্ন পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারে এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ওপর এই ই-রিটার্ন জমা দেওয়ার বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়া হয়নি। বরং যেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা আগে থেকেই ডিজিটালাইজড পরিবেশে কাজ করতে অভ্যস্ত এবং যেসব প্রতিষ্ঠান প্রায় শতভাগ ডিজিটালাইজড তাদেরকেই মূলত এই ই-রিটার্ন কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে।
এতে তারাও স্বস্তি পাচ্ছেন। কারণ, তাদেরকে আর রিটার্ন জমা দেওয়ার জন্য আয়কর অফিসে যেতে হচ্ছে না। ঘরে কিংবা অফিসে বসেই তারা নিজেদের রিটার্ন নিজেরাই জমা দিতে পারছেন। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এই ই-রিটার্ন কার্যক্রমের আওতায় আনার কথা জানান এনবিআর চেয়ারম্যান।
ই-রিটার্ন জমা দিতে রয়েছে এনবিআরের হেল্পলাইন ॥ করদাতারা অনলাইনে নিবন্ধন ও রিটার্ন জমা দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হলে তারা এনবিআরের কল সেন্টারের সহায়তাও নিতে পারবেন। এ জন্য কল সেন্টার চালু রয়েছে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। কল সেন্টারের নম্বর ০৯৬৪৩৭১৭১৭১। কল সেন্টারে ফোন করলে একজন কর কর্মকর্তা করদাতাদের এ সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যার সমাধানে সহায়তা দেবেন। এছাড়া www.etaxnbr.gov.bd এর ই-ট্যাক্স সার্ভিস অপশন থেকে করদাতারা ই-রিটার্ন সংক্রান্ত যে কোন সমস্যা লিখিতভাবে জানাতে পারবেন এবং সমাধান পাবেন।
এদিকে অনলাইনে শুধু করদাতা হিসেবে নিবন্ধন কিংবা রিটার্ন তৈরি ও জমা দেয়াই নয়, এর মাধ্যমে কর পরিশোধও করা যাবে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেকোনো করদাতা রিটার্ন জমার পাশাপাশি কর পরিশোধ করতে পারবেন। এছাড়া একই অনলাইন ব্যবস্থা থেকে দাখিল করা রিটার্নের কপি, প্রাপ্তি স্বীকারপত্র, আয়কর সনদ, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ডাউনলোড ও প্রিন্ট করতে পারবেন করদাতারা।
করযোগ্য আয় ৫ লাখ টাকার কম হলেই এক পাতার বিবরণী ॥ যে সমস্ত করদাতার বার্ষিক করযোগ্য আয় ৫ লাখ টাকার কম, তারা এক পাতায় তাদের আয়কর বিবরণী জমা দিতে পারবেন। এরমধ্যে করদাতার জন্য এক পাতার একটি ফরম প্রকাশ করেছে এনবিআর। এক পাতার ওই ফরমে সব মিলিয়ে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হবে। এগুলো হলো: নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), সার্কেল, কর অঞ্চল, করবর্ষ, আবাসিক মর্যাদা, মোবাইল নম্বরসহ যোগাযোগের ঠিকানা, আয়ের উৎস, মোট পরিসম্পদ, মোট আয়, আরোপযোগ্য কর, কর রেয়াত, প্রদেয় কর, উৎসে কাটা করের পরিমাণ (যদি থাকে) এই রিটার্নের সঙ্গে প্রদত্ত কর ও জীবনযাপন ব্যয়।
নভেম্বর মাসজুড়ে দেওয়া হবে আয়কর তথ্য সেবা ॥ ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছরই আয়করদাতাদের জন্য নভেম্বর মাসে আয়কর মেলার আয়োজন করা হলেও গত চার বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না এই মেলা। এবারও আয়কর মেলা আয়োজনের পরিবর্তে সব কর অঞ্চলে বিগত বছরের মত পুরো নভেম্বর মাসজুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার জন্য সেবা দেওয়া হবে বিভিন্ন কর অফিসে।
আয়কর তথ্য সেবা মাসে বাংলাদেশের ৮৬৯টি সার্কেলের করদাতাদের ৪১টি কর অঞ্চলে সেবা বুথ স্থাপনের মাধ্যমে নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে আয়কর রিটার্ন গ্রহণের সেবা দেয়ার কথা জানিয়েছে এনবিআর। এই আয়কর তথ্যসেবা কেন্দ্রে ই-টিআইএন রেজিস্ট্রেশন, অনলাইন রিটার্ন রেজিস্ট্রেশন, অনলাইন রিটার্ন দাখিল, ই-পেমেন্টের (এ-চালান ও অন্যান্য) ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।
অতীতেও ছিল অনলাইনে রিটার্ন জমার ব্যবস্থা ॥ অবশ্য অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের করদাতাদের জন্য একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা নয়। এর আগেও অনলাইনে রিটার্ন জমার ব্যবস্থা করেছিল এনবিআর। তবে নানা কারণেই তখন এই পদ্ধতি আগ্রহী করতে পারেনি করদাতাদের। সর্বপ্রথম ২০১৬ সালে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়।
তবে করদাতাদের থেকে তেমন সাড়া না পাওয়ায় ২০১৯ সালে তা বন্ধ করে দেয় এনবিআর। তবে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে ফের এনবিআরের উদ্যোগে এই অনলাইনে রিটার্ন জমার ব্যবস্থা চালু হয়। সবশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুই লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে রিটার্ন জমা দেন।
অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার ॥ ঘরে বসে ঝামেলামুক্তভাবে আয়কর জমা দেওয়ার জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে এক ভিডিও বার্তায় জনগণকে অনলাইনে রিটার্ন ও আয়কর জমা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তার বক্তব্য, ‘আপনাদের দেয়া করই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। অথচ সরকারের কাছে করের টাকা জমা দিতেই পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। এখন থেকে ব্যাংকে লাইন দিয়ে আয়কর জমা দেয়া বা আয়কর অফিসে গিয়ে রিটার্ন জমা দেয়ার ঝামেলা করতে হবে না। আপনি ঘরে বসেই আয়কর জমা দিয়ে রিটার্ন দাখিল করবেন- এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
কোন প্রতিষ্ঠান কত বেশি করদাতার আয়কর রিটার্ন অনলাইনে দিচ্ছেন, তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার অর্জনের জন্য জেলায় জেলায়, শহরে শহরে প্রতিযোগিতার কথাও এ সময় উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। পাশাপাশি করদাতাদের এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য তরুণ-তরুণীদের প্রতিও অনুরোধ জানান প্রধান উপদেষ্টা।