জিয়াউর রহমান
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই মূলত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। সেই সময় ৭ নভেম্বরের পর কীভাবে পরিস্থিতি শান্ত করেছিলেন জিয়াউর রহমান! ইতিহাস বলে, তখন পুরো নভেম্বর মাসই ছিল উত্তাল ও অস্থির। তারপরও দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের হাল ধরেন।
ক্ষমতায় এসে উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন জিয়াউর রহমান। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নতুন নতুন কর্মসূচি নিয়ে দেশকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেন। মূলত জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছিল।
সেনানিবাসের ভেতর ও বাইরে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে একের পর এক ঘটনা ঘটছিল। সেই অস্থির সময়ের ঘটনাপ্রবাহ সেনাবাহিনীতে কর্মরত কর্মকর্তাদের লেখা বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে। ওই সব বইয়ের সূত্রে বোঝা যায়, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান মূলত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের পরিকল্পনায় হয়। কিন্তু তার সুফল পেয়েছেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।
৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান
৭ নভেম্বরের ছিল ওই বছর ঢাকা সেনানিবাসে তিন মাসের ব্যবধানে ঘটা তৃতীয় অভ্যুত্থান। সেনাবাহিনীর মধ্যে ওই অভ্যুত্থান ঘটাতে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়েছিল জাসদের গোপন সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। নভেম্বরের ৩ তারিখে খালেদ মোশারফ পাল্টা অভ্যুত্থান করেন। তিনি নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন। সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান চিফ অব মিলিটারি স্টাফ জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা হয়।
এরপর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে ঢাকা সেনানিবাসে সৈনিকেরা বিদ্রোহ করে। ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে তারা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। মুক্তির পর রেকর্ড করা এক রেডিও ভাষণ ৭ নভেম্বর সকালে বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হয়েছিল। তাতে জেনারেল জিয়া বলেছিলেন, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন তিনি।
'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা' বইয়ে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট কর্নেল এমএ হামিদ লিখেছেন, ওই ভাষণে জেনারেল জিয়া বলেন, 'দেশের এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অনুরোধে এই কাজ করেছেন'। এবং 'সবাইকে শান্ত থাকা'র আহ্বান জানান তিনি।
বন্দিদশা থেকে যেভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে এলেন জিয়া
জিয়াউর রহমানের ওই রেডিও ভাষণের পর অভ্যুত্থানে গণবাহিনীর ভূমিকা চাপা পড়ে যায়। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা জন্মে যে, এটি পুরোপুরিই জিয়াউর রহমানের অভ্যুত্থান।
এভাবেই ৭ নভেম্বরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন জিয়াউর রহমান। ওইদিনই বঙ্গভবনের বদলে সারাদেশের দৃষ্টি ঘুরে যায় ক্যান্টনমেন্টের দিকে। বিশেষ করে টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিস-ব্যারাকের দিকে।
লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, জেনারেল জিয়া এবং কর্নেল তাহেরের মধ্যে মতানৈক্য চরমে পৌঁছে। কারণ জিয়াউর রহমান সৈনিকদের দেয়া সব দাবি মেনে নিতে চাইছিলেন না। সৈনিকেরা তখন অফিসারদের বিরুদ্ধে পাল্টা-বিপ্লবের প্রস্তুতি নেয়।
ওই রাতে বিপ্লবী সৈনিকদের গুলিতে ঢাকা সেনানিবাসে ১২ জন কর্মকর্তা নিহত হন। আক্রান্ত হয়েও মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান কয়েকজন। এরপরের কয়েকদিন সেনানিবাসের ভেতরে এবং বাইরে ছিল খুবই ঘটনাবহুল।
সে সময় কর্নেল তাহেরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তার ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন, যিনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। আনোয়ার হোসেন বিবিসি বাংলার কাছে এভাবে বর্ণনা দিয়েছিলেন, কর্নেল তাহের পরিকল্পনা করেছিলেন অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া সৈন্যরা অস্ত্র হাতে রাস্তায় বেরিয়ে আসবে। তিনি সৈন্যদের বলেছিলেন প্রত্যেকে কয়েকটি অস্ত্র হাতে বেরিয়ে আসবে। আর বাইরে অপেক্ষমাণ আমাদের শ্রমিক ও ছাত্ররা সশস্ত্র হবে। এভাবেই সৈনিক জনতার অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন কর্নেল তাহের। আমাদের লক্ষ্য ছিল অভ্যুত্থানের পর একটি বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল হবে, রাজবন্দীদের মুক্ত করা হবে এবং দেশে একটা সাধারণ নির্বাচন দেয়া হবে।
সে সশস্ত্র পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফের বন্দিদশা দশা থেকে মুক্ত হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।
অভ্যুত্থানের পরের কয়েকটি উত্তাল দিন
অভ্যুত্থানের মূল কেন্দ্র ঢাকা সেনানিবাসের ভেতরে ছিল চরম উত্তেজনাপূর্ণ। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে সেই একই অবস্থা ছিল না।
রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ জাসদের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, সেই সময় আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি সিপিবি ছাড়া বাকি সব রাজনৈতিক দল, যাদের মধ্যে ইসলামপন্থী ও চীনপন্থী বাম দল সবাই এই অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিল।
লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, মহান সিপাহী বিপ্লব' ৮ নভেম্বর ভিন্ন আকার ধারণ করে। জেনারেল জিয়ার সঙ্গে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি নিয়ে জাসদ নেতাদের দফায় দফায় বৈঠক হয়।
তিনি তখন সিনিয়র জেসিও অর্থাৎ জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারদের আলোচনা চালাচ্ছিলেন। সৈনিকদের কাছে আবেদন করছিলেন যাতে কেউ আর রক্তপাত না ঘটায়। সেই সঙ্গে জেনারেল জিয়া সারাদিন ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন ইউনিটে ঘুরে সৈনিকদের অস্ত্র জমা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে অফিসারদের অধিকাংশই আগের রাতে পালিয়ে গিয়েছিলেন, পরের দিন ৮ নভেম্বরও সে অবস্থা চলেছে সারাদিন।
এর আগে ওই দিন মানে নয় তারিখ সকালে আর্মি হেড কোয়ার্টারে মিটিং ডাকেন জেনারেল জিয়া। যার মূল লক্ষ্য ছিল অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পরিকল্পনা করা। তাতে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা এবং এর আশেপাশের সেনানিবাসগুলো থেকে ৩০ জনের মত সামরিক কর্মকর্তা।
ওইদিন ঢাকা সেনানিবাস কার্যত অচল ছিল, কোন কাজকর্ম হয়নি। কিন্তু ঢাকা শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। বিকেলে জাসদ একটি বিজয় মিছিল বের করে বায়তুল মোকাররমে। সেটিতে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল, যদিও তাতে কেউ আহত হয়নি।
এর মধ্যে ৯ নভেম্বর সিএমএইচ থেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের লাশ সেনানিবাস গোরস্থানে দাফন করা হয়।
ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, অভ্যুত্থানের পরের দুই-তিনদিনের মধ্যে জিয়াউর রহমান পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। বিদ্রোহী সৈনিকদের শান্ত করার জন্য ১০ নভেম্বর একটি বৈঠক ডাকা হয়েছিল।
ওইদিন জেনারেল জিয়াউর রহমান টু-ফিল্ড ব্যারাক থেকে সেনাসদরে অফিস করতে শুরু করেন। সেখান থেকে সৈনিকদের কাছ থেকে অস্ত্র ফেরত আনা এবং 'কমান্ড কন্ট্রোল' ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করতে থাকেন।
তাদের শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে তার কোমরের আর্মি বেল্ট খুলে মাটিতে ছুঁড়ে দেন এবং বলেন, এত দাবিদাওয়া উঠলে- আমি আর এ আর্মির চিফ থাকতে চাই না। এরপর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। সৈনিকদের দাবি ধাপে ধাপে মেনে নেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়। এরই মধ্যে কর্মকর্তাদের মধ্যে দায়িত্ব বদলে দেয়া হয় অনেকের, কয়েকজনকে গৃহবন্দি করা হয়। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আদেশ দেয়া হয় কর্মকর্তাদের।
লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, নভেম্বরের ১৪/১৫ তারিখের মধ্যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পরিস্থিতি প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এসআর