রুহুল আমিন স্বপন ও আমিন নূর
মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে প্রতারণা ও কর্মী পাঠানো নিয়ে সিন্ডিকেটের দুই হোতাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাদের যথাসম্ভব দ্রুত দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করার জন্যই এমন জোর তৎপরতা চলছে। তাদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে লাখ লাখ শ্রমিকের কাছ থেকে বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে দেশ বিদেশে তোলপাড় দেখা দেওয়ায় এখন দেশান্তরী হয়েও স্বস্তিতে নেই।
আমিনুল ইসলাম বিন নূর ও রুহুল আমীন স্বপন ওই সিন্ডিকেটের প্রধান দুই হোতা হিসেবে দেশী বিদেশী মিডিয়ায় ফলাও করে প্রতিবেদন ছাপা হলেও বিগত সরকারের সময়ে সিন্ডিকেটের শীর্ষ হোতারা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি বেগতিক আচ করতে পেরে রুহুল আমিন স্বপনসহ বেশ কজন দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নেন। আর দেশে অবস্থান করে সাবেক জনশক্তি মন্ত্রী ইমরান আহমেদসহ কজন মামলার আসামি হযে বর্তমানে কারাগারে আটক। বাকিরা রয়েছেন ঢাকায় আত্মগোপনে। স্বপনকে আটক করে দেশে ফেরত পাঠাতে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ।
গত ২৪ অক্টোবর ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা থেকে চিঠিটি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, আমিনুল ইসলাম ও রুহুল আমিন নামে ওই দুই ব্যবসায়ী ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আদায় করে তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সুযোগ করে দিয়েছেন। তারা দুজন এ ব্যবস্থায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখার পুলিশ পরিদর্শক আশিকুর রহমান গত রবিবার টেলিফোন সাক্ষাৎকারে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
উল্লেখ্য প্রায় ছয় বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালের আগস্টে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগ শুরু করে মালয়েশিয়া। এ বছরের ৩১ মে পর্যন্ত ৪ লাখ ৭৬ হাজার কর্মী দেশটিতে যায়। এর পর বন্ধ করে দেওয়া হয় নিয়োগ। ফলে অনুমতি পেয়েও প্রায় ১৭ হাজার কর্মী যেতে পারেননি।
জানা গেছে-মালয়েশিয়া সরকার ২০২২ সালের জুনে ২৫ বাংলাদেশী রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর কাজ দেয়। এসব এজেন্সি সিন্ডিকেট নামে পরিচিতি পায়। এতে চার সাবেক বাংলাদেশী মন্ত্রী ও এমপির প্রতিষ্ঠান ছিল। সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক ছিলেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মালয়েশীয় নাগরিক আমিনুল ইসলাম আব্দুন নুর। বাংলাদেশ অংশের নিয়ন্ত্রণ করতেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী রুহুল আমিন স্বপন। তখন বাংলাদেশ সরকার প্রত্যেক কর্মীর অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করেছিল ৭৯ হাজার টাকা।
কিন্তু প্রত্যেক কর্মীর কাছ থেকে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নেওয়া হয়। সিন্ডিকেটের বাংলাদেশ অংশের নিয়ন্ত্রকরা ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা করে নেন। মালয়েশিয়ার নিয়ন্ত্রকরা ভিসাপ্রতি ছয় হাজার রিঙ্গিতের সমপরিমাণ প্রায় দেড় লাখ টাকা নেয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ ছেড়ে যান রুহুল আমিন স্বপন।
বিগত সরকারের মন্ত্রী লোটাস কামাল, বেনজির আহমেদ এমপি, নিজাম হাজারী এমপি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ এমপি,
কাল ফিরোজ আবুল বাশার (বায়রার পলাতকসভাপতি ও যুবলীগ নেতা) মনসুর আহমদ কালাম (আওয়ামী লীগ নেতা), মহিউদ্দিন মহি (আওয়ামী লীগ নেতা), কাজী মফিজুর রহমান স্বত্বাধিকারী কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, মোবারক উল্লাহ শিমুল স্বত্বাধিকারী আদিব এয়ার ইন্টারন্যাশনাল এবং কি শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফরহমানের যোগ সাজশে মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে চরম অরাজকতা, অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন ও তার সহযোগীরা।
তার পর দেশের প্রথম সারির সব পত্রিকা ও টেলিভিশনে এই ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। মাঠে নামে দুদক। বিগত সরকার পতনের এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়। তার পর গ্রেপ্তার হন সাবেক মন্ত্রি ইমরান আহমেদ। ওই মামলায় শতাধিক আসামি এখনো পলাতক। যাদের বেশীর ভাগই ঢাকায় ঘাপটি মেেের আছে।এতে আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন সংস্থাও উদ্বেগ প্রকাশ করে।
এ সম্পর্কে বায়রার সাবেক এক নেতা জানান- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সাবেক সরকারের পক্ষে এবং ছাত্র-জনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় ছাত্র-জনতা হত্যার হুকুমের আসামি হিসেবে বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। তার পর রুহুল আমীন স্বপন পালিয়ে গেলেও এখনো তার মালয়েশিয়ার পার্টনার দাতো আমিন ও কাজী মফিজুর রহমানকে নিয়ে বর্তমান সরকারকে চরম বিব্রত করার জন্য পুনরায় মালয়েশিয়া শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচেছ। এবারও তারা বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয়ার মিশন নিয়ে মাঠে নামছে।
গত সপ্তাহে আবুল বাশার ও রুহল আমীন স্বপন জুম বৈঠকে বায়রার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। মূলত আগের অনিয়ম, দুর্নীতি ও টাকা পাচারের বিচার না হওয়ার কারণে তারা এই ধরণের দুঃসাহস দেখাচ্ছে। মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেটের হোতা বাংলাদেশ প্রান্তে বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন (ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল - আরএল ৫৪৯) ও মালেশিয়া প্রান্তে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ার নাগরিক দাতো শ্রী আমিন। তার মালয়েশিয়ান কোম্পানি বেস্টাইন দিয়ে শুধু কর্মী আনার জন্য অনলাইন সাপোর্টের চুক্তি হয়।
তার পর তিনি রুহুল আমিন স্বপনকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন প্রথমে দশজনের , পরে পঁচিশ জনের সর্বশেষ ১০১ জনের সিন্ডিকেট। বহুল আলোচিত এই সিন্ডিকেট ঢাকা থেকে সরকার ঘোষিত মাত্র ৭৯ হাজার টাকা ব্যয়ের শ্রমিককে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে হািতয়ে নেয় কমপক্ষে ৮ হাজার কোটি টাকা। প্রতিটি শ্রমিকের কাছ থেকে শুধু তাদের কোম্পানির চার্জ বাবদ ১ লাখ ৭ হাজার টাকা হারে হাতিয়ে নিয়েছে বিলিয়ন ডলার।
সিন্ডিকেটের বাকি সদস্যরা হলেন বায়রা সদস্য-সাবেক এমপি নিজাম হাজারী, জেনারেল মাসুদ এমপি, বেনজীর এমপি, আবুল বাশার, কাজী এয়ারের কাজী মফিজুর রহমান, আদিব এয়ার ইন্টারন্যাশনালের মোবারক উল্লাহ শিমুল, রাবেতা ইন্টারন্যাশনালের মালিক আবুল বাশার, বায়রার মহাসচিব আওয়ামী লীগ নেতা আলি হায়দার চৌধুরী, কৃষক লীগ নেতা ও কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি ফিরোজ। রুহুল আমীন স্বপন পালিয়ে গেলেও তাদের সহযোগী হিসেবে এরাই আবার তৎপর হয়েছে। জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার ফের চালুর ঘোষণার পর তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন স্বপন ও বাশার।